একজন ব্যাটার তাঁর দিকে ধেয়ে আসা সমালোচনার উত্তর কিভাবে দেয়?
নিশ্চিতভাবেই রান দিয়ে, ফিফটি দিয়ে, বড় রানের ইনিংস খেলে। কিন্তু এ মানদণ্ডটাই যেন বদলে যায় নাজমুল হোসেন শান্ত’র বেলায়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে রান করে যাচ্ছেন, বিপিএলে এসেও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন। তারপরও সমালোচনা যেন পিছুই ছাড়ে না।
তীক্ষ্ণ সমালোচনার তীব্রতায় একটা সময় পর মনে জমে থাকা দু:খের কথাটা বলেই ফেললেন শান্ত। অনেকটা আক্ষেপ ঝেড়েই বললেন, দেশের হয়ে খেলেও তাঁর মনে হয় তিনি প্রতিপক্ষের ভূমিকায় খেলছেন।
অথচ বিশ্বকাপ থেকে বাংলাদেশের যে দুই একজন হাতেগোনা ব্যাটার এই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ধারাবাহিকভাবে রান পাচ্ছেন তাদের মধ্যে শান্ত অন্যতম। বিপিএল শুরুর আগে সিলেট স্ট্রাইকার্সের অধিনায়ক মাশরাফি শান্ত’র মাঝে কিছু একটা খুঁজে পেলেন। এত সমালোচনার মধ্যেও যে রান করতে পারে সে দলের হয়ে বড় এক সম্পদ হতে পারে। ড্রাফটে তাই ক্যাপ্টেন ম্যাশের প্রথম পছন্দে উঠে এল শান্তর নাম।
মাশরাফির সে আস্থার পূর্ণ প্রতিদান দিলেন শান্ত। বিপিএলের শুরুটা হল দুর্দান্ত। কোনো ফিফটি নাই। তবে দুটো ম্যাচেই চল্লিশোর্ধ ইনিংস। এক ম্যাচ বিরতি দিয়ে সেই না পাওয়া ফিফটিও হাঁকালেন। শান্তর ধারাবাহিকতায় সিলেট স্ট্রাইকার্সও দারুণ ধারাবাহিক। টানা ৫ ম্যাচে জয়।
মাঝে ফিফটির পরের দুই ম্যাচে রান পেলেন না। আর তাতেই সমালোচনা আবার ঘিরে ধরল। ব্যাপারটা এমন যে, ম্যাচের পর ম্যাচ রান করেই সমালোচনার স্রোত ঠেকাতে হবে শান্তকে। শেষ কবে বাংলাদেশের কোন ব্যাটার এমন প্রত্যাশার অসম চাপ সামলাতে পেরেছেন? শান্ত’র কাছে সে উত্তর নেই,উত্তরটা নেই কট্টর সমালোচকদের কাছেও।
শান্ত জানেন, তাঁকে রান করেই টিকে থাকতে হবে। রান না পাওয়া ম্যাচ মানেই গ্যালারি থেকে শুরু থেকে ঐ সহস্র মাইল দূরে ফুরিয়ে যাওয়ার সুর। এমন সুর ঠেকাতে তাই প্রয়োজন বড় ইনিংস।
দুই ম্যাচ আগেই ঢাকা ডমিনেটর্সদের বিপক্ষে ৫৭ রানের ইনিংস খেলেছেন। সেই শান্তকেই দুই ম্যাচ বাদে আবারো মাঠে নামতে রান করার চাপ নিয়ে। বারংবার এমন পরিস্থিতিতে শান্তর হয়তো কিছুটা উপকারই হয়েছে। কঠিন পরিস্থিতি সামলাতে শিখে যাচ্ছেন। রান করতে শিখছেন। বড় ইনিংস খেলেও আরো রানের জন্য আর তৃষ্ণার্ত থাকছেন। রানের জন্য তৃষিত শান্ত পরের ম্যাচেই খেললেন ৮৯ রানের লম্বা এক ইনিংস। এবারের বিপিএলে এখন পর্যন্ত যা বাংলাদেশি ব্যাটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।
নাজমুল হোসেরন শান্ত’র বড় ইনিংস খেলার যাত্রাটা সেখানেই থেমে থাকল না। এক ম্যাচ বিরতি দিয়েই আবারো শান্ত ঝলক। এবার এমন এক সময়ে ব্যাট করতে নামলেন যখন দলের উড়ন্ত শুরু প্রয়োজন। শান্তকে নিয়ে আরেক সমালোচনার নাম হল, ধীর গতির ব্যাটিং। কিন্তু চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের দেওয়া ১৭৫ রানের টার্গেটে তো শান্তকে অশান্ত রূপেই আবির্ভূত হতে হবে।
এমন গুরু দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন শান্ত। শুরু থেকে আক্রমণাত্বক ভঙ্গিমায় ব্যাট করতে থাকলেন। তাতে সিলেট স্ট্রাইকার্সও পেল উড়ন্ত সূচনা। পাওয়ার প্লে’র প্রথম ৬ ওভারে ৫৫। তাতে শান্তর একারই ২৫ বলে ৪৩ রান। প্রাথমিক দায়িত্ব ঠিকঠাকভাবেই পালন করেছেন। তবে সিলেটকে সুবিধাজনক অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য শান্তর উইকেটে তো আরো থাকা প্রয়োজন। এবার ক্যালকুলেটিভ ব্যাট করলেন শান্ত। নিজের ফিফটি তুলে নিলেন। ব্যক্তিগত ৬০ রান করে থামলেন। তবে ততক্ষণে ম্যাচ সিলেটের হাতের মুঠোয়।
বিপিএলে এখন পর্যন্ত ৯ ম্যাচ খেলেছেন শান্ত। ৩ ফিফটি আর ২ চল্লিশোর্ধ্ব ইনিংসে রান করেছেন ৩৫০। গড়টা ৫০। সমালোচকদের উদ্দেশ্যে হয়তো তিনি একটা বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে, এবারের বিপিএলে এখন পর্যন্ত সর্বাধিক রান সংগ্রাহক ব্যাটারের নাম নাজমুল হোসেন শান্ত। একই সাথে, টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ফিফটি, সর্বোচ্চ চার-দুটোই শান্তর।
হ্যাঁ। শান্ত জানেন, পরের ম্যাচেই খারাপ খেললে আবারো সমালোচনায় বিদ্ধ হবেন তিনি। তাই নিজেকে টিকিয়ে রাখার লড়াইটা তাঁর নিজের সাথে। এমন অদম্য মানসিকতাই দিন শেষে শান্তকে রানের জন্য আরো অশান্ত করে তোলে।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দলের হয়ে সর্বোচ্চ রান করেছিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। বাংলাদেশের জেতা দুই ম্যাচে একটিতেও ম্যাচসেরা হননি। কিন্তু ঐ দুই ম্যাচ মিলিয়ে সর্বোচ্চ রান করা ব্যাটারের নাম ছিল এই শান্তই। তবে টুর্নামেন্ট শেষে ব্যাটারদের মধ্যে ভারতের বিপক্ষে লিটন দাশের ঐ ঝড়ো ইনিংসটাই উঠে এসেছে শুধু।
কোনো সন্দেহ নেই, দুর্দান্ত এক ইনিংস ছিল সেটি। কিন্তু দিন শেষে সে ম্যাচটিতে বাংলাদেশের জয় আসেনি। যে দুটি ম্যাচে জয় এসেছিল সেই দুই ম্যাচে নিরবে, নিভৃতে পারফর্ম করেছিলেন শান্ত। তবুও কোনো এক অদ্ভুত কারণে শান্ত থেকে যান অপ্রিয়দের কাতারেই।
এবারের বিপিএলে দুর্দান্ত ফর্মে আছেন। তাঁর দরুন দল জয়ও পাচ্ছে। কিন্তু তারপরও শান্ত থেকে যান আলোচনার আড়ালেই। অবশ্য এই পরিস্থিতিগুলোই শান্তকে যেন আরো পরিণত করে তুলছে। তিনি জানেন, তাঁকে ঐ বাইশ গজে রান করেই টিকে থাকতে হবে। সমালোচনার মোক্ষম জবাব নয়, নিজের প্রধান যে কাজ, রান করা- সেটা অব্যাহত থাকলেই হল। সেটাই তাঁর ক্যারিয়ারকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে।