টেস্ট ক্রিকেটের সেরা প্রদর্শনী অ্যাশেজ হলেও ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার বোর্ডার – গাভাস্কার ট্রফি কম উত্তাপ ছড়ায় না। গত ৭৫ বছরে এই দুই দেশের ক্রিকেট বৈরিতা ক্রমশই বেড়েছে। আসুন দেখে নেয়া যাক টেস্টে ভারতের মাটিতে এই সিরিজের অতীতের স্মরণীয় ঘটনাগুলো।
- ১৯৬৯: ব্রাবোর্নে আগুন আর বিক্ষোভের দাবানল
ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে সেবার দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৯ রান তুলতেই সাত উইকেট হারিয়ে বসে ভারত। ম্যাচ জিততে হলে তাই অলৌকিক কিছুই করতে হতো স্বাগতিকদের। সৈয়দ আবিদ আলির বিদায়ে ক্রিজে তখন শ্রীনিবাস ভেংকটরাঘবন এবং অজিত ওয়াদেকার।
দুজনে মিলে ইনিংস খানিকটা মেরামতের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু দলীয় ১১৪ রানের মাথায় ভেংকটরাঘবনের বিপক্ষে বিতর্কিত এক কট বিহাইন্ডের আবেদনে সাড়া দেন শম্ভু পান। ধারাভাষ্যকাররাও নিশ্চিত ছিলেন বল ভেংকটরাঘবনের ব্যাটে লাগেনি।
স্টেডিয়ামে দর্শকরা রীতিমতো উত্তাল হয়ে উঠেন আম্পায়ারের এহেন সিদ্ধান্তে। গ্যালারিতে চেয়ার ভাঙচুরের পাশাপাশি মাঠে বোতল ছুঁড়তে শুরু করেন। এরপর ঘটে ভয়াবহ কান্ড, ভরা গ্যালারিতেই আগুন জ্বালিয়ে দেন তাঁরা।
কিংবদন্তি অজি ক্রিকেটার রে রবিনসন ঘটনাটা বর্ণনা করেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বুনো টেস্ট হিসেবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এমন আশংকা থাকলেও অজি কাপ্তান বিল লরি খেলা চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন এবং ভারত অল আউট হয়ে যায় ১২৫ রানেই।
৬৪ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে সহজেই ম্যাচ জিতে নেয় স্বাগতিকরা। পরবর্তীতে ৩-১ ব্যবধানে সিরিজও জিতেছিল অজিরাই।
- ১৯৮৬: বিখ্যাত টাই টেস্ট
মাদ্রাজের সেই টেস্ট স্মরণীয় হয়ে থাকবে প্রয়াত ডিন জোন্সের ডাবল সেঞ্চুরির জন্য। প্রতিকূল সেই পরিবেশে রীতিমতো অতিমানবীয় ব্যাটিং করেছিলেন তিনি।
অজিদের দেয়া ৩৪৮ রান তাড়া করতে নেমে ভালোই এগোচ্ছিল স্বাগতিকরা। কিন্তু বাঁহাতি স্পিনার রে ব্রাইট তিন উইকেট তুলে দ্রুত ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন সফরকারীদের। শেষ উইকেট হাতে নিয়ে ভারতের দরকার ছিল চার রান। ক্রিজে অভিজ্ঞ রবি শাস্ত্রীর সাথে তখন এগারো নম্বর ব্যাটার মনিন্দর সিং।
কিন্তু সেই ম্যাচে দশ উইকেট নেয়া অফস্পিনার গ্রেগ ম্যাথুজের নৈপুণ্যে ভারত কেবল তিন রানই নিতে পারে। যদিও মনিন্দরের দাবি ছিল বলটা তাঁর ব্যাটে লাগেনি। কিন্তু আম্পায়ার আঙ্গুল তুলে দেন এবং ক্রিকেট ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো টেস্ট ম্যাচ ড্র হয়। আম্পায়ার বিক্রম রাজু এরপর আর কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে দাঁড়াতে পারেননি।
এর আগে অবশ্য মাদ্রাজের তীব্র গরমে ২১০ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলেন ডিন জোন্স। ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপামাত্রাতেও প্রায় সাড়ে আট ঘন্টা ব্যাট করেছিলেন তিনি। তিনি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে ইনিংস শেষেই তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল।
- ২০০১: হরভজন, লক্ষণ এবং ইতিহাস
২০০১ সালে ১৬ টেস্ট জিতে পালকে শেষ পালক যোগ করতে ভারত সফরে আসে স্টিভ ওয়াহর সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া। প্রথম টেস্টে দশ উইকেটে জিতে সিরিজে চালকের আসনে ছিল অজিরাই। কলকাতা টেস্ট তাই ভারতের জন্য ছিল বাঁচা মরার লড়াই।
প্রথম ইনিংসে তরুণ হরভজন সিংয়ের হ্যাটট্রিক সত্ত্বেও ৪৪৫ রানের সংগ্রহ পায় অজিরা। জবাব দিতে নেমে মাত্র ১৭১ রানে অল আউট হয়ে ফলো অনে পড়ে স্বাগতিকরা। দ্বিতীয় ইনিংসেও ২৩২ রান তুলতেই হারিয়ে ফেলে টপ অর্ডারের চার উইকেট।
এরপরই রাহুল দ্রাবিড় এবং ভিভিএস লক্ষণ মিলে শুরু করেন পাল্টা আক্রমণ। তাঁদের ৩৭৬ রানের অতিমানবীয় জুটিতে ভারত থামে ৬৫৭ রানে। ৩৮৪ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে হরভজন সিংয়ের তোপে পড়ে ২১২ রানেই গুটিয়ে যায় সফরকারীরা। সেই ম্যাচে ১৩ উইকেট নেন তরুণ হরভজন। দ্রাবিড়, লক্ষণ এবং হরভজন নাম খোদাই হয়ে যায় টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্সের তালিকায়।
- ২০০৫: নাগপুর হয়ে উঠেছিল গ্যাবা
তিন বছর বাদে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের নেতৃত্বে অবশেষে ভারতে বিজয় কেতন উড়িয়েছিল অজিরা। বেঙ্গালুরুতে জয় আর চেন্নাইতে ড্রয়ের পর সিরিজ জপ্য নিশ্চিত করতে নাগপুরে জয়ের বিকল্প ছিল না সফরকারীদের সামনে।
উইকেটে জ্যাসন গিলেস্পি এবং গ্লেন ম্যাকগ্রার সুবিধার জন্যই যেন ঘাস রেখেছিলেন কিউরেটর। ম্যাচের আগেই ইনজুরির কারণে নাম সরিয়ে নেন ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি এবং হরভজন সিং। অনেকের মতে সৌরভের নিষেধ সত্ত্বেও পিচে ঘাস রাখায় তিনি সেই ম্যাচ খেলেননি। সেটা ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের ক্রান্তিকাল, জগমোহন দালমিয়া তখন ধীরেধীরে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন বোর্ডের উপর থেকে।
সেই টেস্টে অজি পেসারদের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। ৩৪২ রানের বিশাল ব্যবধানে ম্যাচ জিতে ভারতের মাটিতে বিজয় নিশান উড়ায় অজিরা।