দুই বছর আগে বাবার সাথে মাঠে কাজ করার সময় মারুফা আক্তার কি ভেবেছিলেন আজকের দিনের কথা! কোভিড-১৯ এর সেই দিনগুলোতে মারুফার দিনই কাটতো মাঠে কৃষিকাজ করেই। অথচ আড়াই বছর বাদে তিনিই কিনা দশ হাজার কিলোমিটার দূরে বিশ্বকাপ মাতাচ্ছেন আপন জাদুতে।
গত মাসটা রীতিমত স্বপ্নের মতো কাটিয়েছেন মারুফা। প্রথমবারের মত আয়োজিত হওয়া মেয়েদের অনুর্ধব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ছিলেন এই তরুণী। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মহাকাব্যিক এক জয়ের পথে ২৯ রানে শিকার করেছিলেন দুই উইকেট।
এরপর বড়দের বিশ্বকাপেও দৃশ্যপটটা বদলায়নি, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২৩ রানে তিন উইকেট নিয়ে রীতিমত চমকে দিয়েছে সবাইকে। অথচ বিশ্বকাপের আগে মাত্র পাঁচ ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন জাতীয় দলের হয়ে। চাপটা তিনি টের পেতে দিলেন কই!
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বোলিং করতে আসেন চতুর্থ ওভারে। লঙ্কানরা তখন ১২৭ রানের লক্ষ্যে নেমে বিনা উইকেটে তুলে ফেলেছে ১৭ রান। মারুফার সামনে রুদ্রমূর্তি ধারণের অপেক্ষায় টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা ব্যাটার চামারি আতাপাত্তু। মারুফা চাপে ছিলেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি উত্তরটা দেন একশব্দেই – না।
প্রথম দর্শনেই পেসার হিসেবে এক পলকে চেনা যায় মারুফাকে। দারুণ অ্যাকশনের পাশাপাশি লাইন লেংথও চমৎকার এই পেসারের। পেস খানিকটা কম হলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে গতি বাড়বে এমনটা আশা করাই যায়। আফ্রিকার মাটিতে সবাই যেখানে খানিকটা খাটো লেংথে বল করতেই বেশি আগ্রহী, সেখানে এই পেসার স্ট্যাম্প টু স্ট্যাম্প গুড লেংথে বল করেই সাফল্য পাচ্ছেন।
আতাপাত্তুর উইকেট নেয়া বলটার কথাই ধরুন না। লংকান ব্যাটার চেয়েছিলেন মিড উইকেট দিয়ে ড্রাইভ করতে, কিন্তু ব্যাটের কানায় লেগে সেটা পরিণত হয় লতা মন্ডলের সহজ ক্যাচে। পরের ওভারেই একই বলে উইকেট তুলে নেন ছোটদের বিশ্বকাপে লংকানদের নেতৃত্ব দেয়া ভিশমি গুনারত্নের। সহজ ক্যাচটা লুফে নিতে কোনো সমস্যাই হয়নি এই বোলারের। পরের বলেই উড়িয়ে দেন আনুশকা সাজনেওয়ানির অফস্ট্যাম্প।
মারুফার দুর্দান্ত বোলিংয়ে ম্যাচের শুরুতেই লংকানদের চেপে ধরে বাংলাদেশ। সবাই ধরে নিয়েছিল লংকানদের বিপক্ষে টানা ছয় ম্যাচ হারের পর অবশেষে জয়ের দেখা পাবে বাংলাদেশের মেয়েরা। কিন্তু সেটা হয়নি, লঙ্কানরা ম্যাচ বের করে নিয়েছে পরিণত ব্যাটিংয়ে। তবে মারুফা নিজের প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচেই প্রতিভার ছাপ রেখেছেন। জানান দিয়েছেন ভবিষ্যৎ তারকা হওয়ার সকল গুণাবলী আছে তাঁর মধ্যে।
ইংরেজি না জানায় ম্যাচশেষে সংবাদ সম্মেলনে মারুফার উত্তরগুলো অনুবাদ করছিলেন অধিনায়ক নিগার সুলতানা। সেখানেই মারুফা জানান ক্রিকেটার হিসেবে নিজের বেড়ে উঠার কথা, শুরুর দিকে বাবার নিষেধের কথা।
তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে আমার পরিবার রাজি ছিল না। আমার বাবা একজন কৃষক। তিনি সবসময় চাইতেন আমি যেন সাধারণ কোনো একটা চাকরি করি। কিন্তু এরপর আমি যখন ভালো করতে শুরু করি, তখন থেকে পরিবার থেকে আর কোনো বাঁধার সম্মুখীন হইনি।’
মূলত বড় ভাইয়ের অনুপ্রেরণাতেই ক্রিকেটের প্রেমে পড়া মারুফার। আইডল হিসেবে মানেন ভারতীয় অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়াকে। বিকেএসপিতে থাকাকালীন সময়েই পেসার হিসেবে ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে ওঠা।
মারুফা বলেন, ‘আমি সেই দিনগুলোতে অনেক পরিশ্রম করেছি। নিজেকে খুব একটা ভালো বোলার ভাবতাম না। তবে স্যার এবং ম্যাডামরা অনেক কিছু শিখিয়েছেন। গ্রাম থেকে উঠে আসার পর জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ পাবার জন্য আমি শিক্ষকদের কাছে কৃতজ্ঞ।”
করোনা মহামারীর সময়েই প্রথমবারের মত নিজের উপার্জনের চল্লিশ হাজার টাকা বাবার হাতে তুলে দেন মারুফা। তখন কি ভেবেছিলেন মাত্র আড়াই বছর বাদে বিশ্ব ক্রিকেটের মঞ্চে আলো ছড়াবেন তিনি? মেয়েদের আইপিএলের নিলামে অবশ্য তিনি নাম দেননি। কিন্তু যে গতিতে এগোচ্ছেন, তাতে ফ্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে তাঁকে নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে যেতে বাধ্য।
অস্ট্রেলিয়ার কোচ শেলি নিটশেক বলেন, ‘আমি তাঁর বোলিং দেখেছি। সে দারুণ বল করে। ব্যাটারদের তাঁকে নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা আছে। তাছাড়া টিম মিটিংয়েও তাঁকে নিয়ে কথা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সে অসাধারণ বল করেছে।’
একটা সময়ে অর্থাভাবে খেলতে যেতে পারতেন না মারুফা। অথচ দুই বছর বাদে তাঁর বল খেলতে হিমশিম খাচ্ছেন বিশ্বসেরা ব্যাটাররা। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা এই আবিষ্কারের জন্য পথটা এখন উন্মুক্ত, সময়টা কেবলই সামনে এগিয়ে যাবার।