অদ্ভুত একটা বিষয় হচ্ছে ১৯৯৪ সাল থেকে ক্রিকেটে আমি অস্ট্রেলিয়ার সমর্থক। আসলে আমি সব সময় সমর্থন করি খেলোয়াড় ভিত্তিক। সেই সময়ে অস্ট্রেলিয়া দলেই প্রিয় খেলোয়াড় বেশি থাকায় সমর্থনটা ওদের দিকেই একটু ঝুঁকে থাকতো।
কিন্তু, বিচিত্র একটা কারণে সেই সময় অস্ট্রেলিয়ার হেটার অনেক বেশি ছিল।
তাই ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালটা যখন দেখতে বসলাম তখন প্রায় ২৫ জন দর্শকের মাঝে আমি একা অস্ট্রেলিয়ার সমর্থক; বাকিদের কেউ ভারতের, কেউ পাকিস্তানের কিংবা কেউ অন্য দলের সমর্থক। কিন্তু সবাই একসাথে অস্ট্রেলিয়া বিরোধী।
আগের সুপার সিক্সের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া জয় পেলেও সেটার পেছনে স্টিভের জীবন পাওয়ার একটা বিষয় ফ্যাক্টর হিসেবে ছিল। এই ম্যাচে তাই দক্ষিণ আফ্রিকাই ফেভারিট হিসেবে শুরু করে।
১৯৯৯ সালের ১৭ জুন। ম্যাচের শুরুটা তেমনই হলো। টস জিতে দক্ষিণ আফ্রিকা ফিল্ডিং নিয়ে প্রথম ওভারেই শূন্য রানে আউট করলো মার্ক ওয়াহকে। এক পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ার স্কোর দাঁড়ালো ১৭ ওভারে ৪ উইকেটে ৬৮ রান।
সেখান থেকে স্টিভ আর মাইকেল বেভান একটা জুটি গড়ে তুললেও রানের গতিটা আফ্রিকা নিয়ন্ত্রণেই রেখেছিল।
সেই মূহুর্তে অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ছিল একটা ব্রেক থ্রু। কাজটা করলেন শেন ওয়ার্ন। ইতিহাসের সেরা লেগ স্পিনারের বিশ্বকাপের শুরুটা মোটেও তার মানের ছিল না। আগের ৮ ম্যাচে পেয়েছিলেন মাত্র ১২ উইকেট। এই পরিসংখ্যান খুব খারাপ না হলেও ঠিক ওয়ার্নসুলভ ছিল না।
কিন্তু গ্রেটরা নাকি জ্বলে ওঠেন দলের সবচেয়ে প্রয়োজনের দিনেই।
গিবসকে অসাধারণ একটা ডেলিভারিতে বোল্ড করলেন ওয়ার্ন, পরের ওভারেই আরেকটা অসাধারণ ডেলিভারিতে বোল্ড করলেন কারস্টেনকে। এক বল পরেই ক্রণিয়েকেও আউট করার পর যেন পুরো অস্ট্রেলিয়া দলই চাঙ্গা হয়ে উঠলো।
কালিনানকে দুর্দান্তভাবে রান আউট করায় কোন উইকেট না হারিয়ে ৪৮ রান থেকে দক্ষিন আফ্রিকা হয়ে গেল ৪ উইকেট হারিয়ে ৬১ রানে।
ধীরে ধীরে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে ফেরত আসলো। ৫৩ রান করে ক্যালিস আউট হবার পর মাঠে নামলেন সেই বিশ্বকাপের বিস্ময় ল্যান্স ক্লুজনার, তখনো প্রয়োজন ৩৬ বলে ৩৯ রান।
কিন্তু ক্লুজনার একপ্রান্ত ধরে এগিয়ে যেতে থাকলো। একটা সুযোগ অবশ্য দিয়েছিল। ৪৮ তম ওভারে ম্যাকগ্রার বলে সহজ একটা ক্যাচ তুলে দিয়েছিল, কিন্তু পল রেইফেল সেই ক্যাচ মিস করে বানিয়ে দেয় ছয় রানে।
অনেক নাটকীয়তার শেষে দক্ষিন আফ্রিকার প্রয়োজন পরে শেষ ৬ বলে ৯ রানের, হাতে ১ উইকেট।
আশার কথা হচ্ছে স্ট্রাইকে ক্লুজনার। প্রথম দুই বলেই অসাধারণ দুটো চার মেরে রানটাকে নিয়ে আসলো সমতায়, প্রয়োজন চার বলে আর মাত্র এক রান। সেই মূহুর্তেই অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ দুর্দান্ত একটা গেইম প্ল্যান করলেন। সব ফিল্ডারকে নিয়ে আসলেন বৃত্তের ভেতরে, উদ্দেশ্য চার মারলে মারুক কিন্তু এক রান করতে দেওয়া হবে না।
চাপে পড়েই কিনা কে জানে, দুই বল বাকি থাকতেই ক্লুজনার কোন রকমে ব্যাটে বল লাগিয়েই পড়িমরি করে দৌড় শুরু করলো। সেই মূহুর্তে ডোনাল্ড দৌড় শুরু করলেও হয়তোবা হয়ে যায় কিন্তু আরো দুই বল আছে বিধায় ডোনাল্ড থামাতে চাইলো ক্লুজনারকে।
যখন দেখলো ক্লুজনারকে থামানো সম্ভব না তখন দৌড় শুরু করলেও ততক্ষনে দেরী হয়ে গিয়েছে অনেক। সুন্দরভাবে রান আউট করে ম্যাচটাকে টাই করে ফেললো অস্ট্রেলিয়ানরা। ম্যাচ টাই হলেও টুর্নামেন্টের বাইলজ অনুযায়ী মুখোমুখি লড়াইয়ে আগের ম্যাচের বিজয়ী দলটাই পেল ফাইনালের টিকেট।
মাত্র ১৬ বলে ৩১ রানের অসাধারণ একটা ইনিংস খেলেও ট্র্যাজিক হিরো হিসেবেই রয়ে গেলেন ক্লুজনার। তবে টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার পেলেন তিনি।
ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস, রেসলিং – জীবনে আরো অনেক খেলাই দেখা হয়েছে। তবে নিজ চোখে সরাসরি দেখা ম্যাচ গুলোর তালিকায় এই ম্যাচটাই প্রথমে থাকবে।