দ্য গ্লোরিয়াস কিউই বার্ড

কেন উইলিয়ামসন – বয়সভিত্তিক দল থেকে তাঁকে ভাবা হতো ‘নেক্সট বিগ থিঙ’। বলা হত এই ছেলে নিউজিল্যান্ডের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হবে। চাইলে এখনই বলে দেওয়া যায় কিন্তু একটু নিরাপদ অবস্থানে থাকতে বলতে হয় তর্কযোগ্যভাবে। কিন্তু যতদিনে ক্যারিয়ার শেষ করবেন আশা করি ততদিনে আর তর্কের অবকাশ থাকবে না।

তার ব্যাটসম্যান সত্তার সাথে সাথে তাঁর মধ্যে যে নেতৃত্বের গুণ ছিলো সেটিও খুব যত্নে লালন করেছিলো নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট। ২০০৮ অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দিলেন। ব্রেন্ডন ম্যাককালামের সহকারী হিসেবে থাকলেন দুই বছর। বিভিন্ন সফরে ব্রেন্ডনকে বিশ্রাম দিয়ে ক্যাপ্টেন্সির দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছিলো তাঁকে।

ধীরে ধীরে তাকে এভাবেই তৈরি করা হচ্ছিলো। অনেক সাক্ষাৎকারে বলেছেন ম্যাককালামের কাছে থেকে শিখেছেন অনেক কিছু। তারপর শেষ পর্যন্ত ২০১৬ তে যখন ম্যাককালাম রিটায়ার করলেন, অফিশিয়ালি এই দলটা হলো তার।

দলে ছিলো ২০০৮ অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপেরই ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদি, কোরি অ্যান্ডারসনরা। নিউজিল্যান্ডের সর্বকালের সেরা একাদশ করতে গেলে এই ব্যাচ থেকেই তিনজন খেলোয়াড়কে নিতে হবে। এতটাই সম্ভাবনাময় ছিলো এই ব্যাচ।পরে তারা সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবেও রূপ দিয়েছেন।

গত ৪ বছরে টেস্ট প্লেয়িং ইলেভেনে সবচেয়ে কম চেঞ্জ এনেছে নিউজিল্যান্ড। ১-১১ এর মধ্যে দশটা জায়গা নিয়েই ভাবতে হয় নাই কখনো। ভাবতে হয়েছে শুধু টম লাথামের ওপেনিং পার্টনার নিয়ে। কখনো মার্টিন গাপটিল কখনো জিত রাভাল আবার কখনো টম ব্লান্ডেল। নয়তো বাকি সব জায়গা বলতে গেলে প্রত্যেকের জন্য ফিক্সড। দলে চেঞ্জ এসেছে কেউ ইনজুরিতে পড়লে অথবা প্লেয়িং কন্ডিশন বুঝে নয়তো কেউ ছুটি নিলে।

২০১৬ হোম সামার শেষে ম্যাককালাম যখন অবসরে গেলেন সেই থেকে ১৭-২০ এই ৪ বছরে ঘরের মাঠে এই দল সিরিজ হেরেছে একটা। সেই একটা সিরিজও ড্র হয়ে যেতো। ৩ টেস্টের সিরিজ দুই ম্যাচ শেষে সাউথ আফ্রিকা ১-০ তে এগিয়ে ছিলো। শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ড জিতে সিরিজ ড্র করতে পারতো। কিন্তু শেষ দিন বৃষ্টির জন্য খেলা না হওয়ায় ম্যাচটা ড্র হয়। সেই সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হারা ম্যাচটাই ঘরের মাঠে শেষ হারা ম্যাচ এবং একই সাথে শেষ সিরিজও।

গত ৩ বছরে নিউজিল্যান্ডে এসে জিতে যেতে পারেনি ভারত, ইংল্যান্ডের মত দল। যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পাকিস্তান শ্রীলংকা ইংলিশ কন্ডিশনে যেয়ে ম্যাচ জিতে, সিরিজ ড্র করে, তারাও নিউজিল্যান্ডে এসে জিততে পারেনি একটি ম্যাচ ও। ঘরের মাঠে অপরাজিত টানা ১৮ ম্যাচ।

এই দলের ব্যর্থতাও আছে। ভারতে ২০১৬ সালে তিন ম্যাচের সিরিজ ৩-০ তে হেরেছে। তখন মাত্রই রিবিল্ডিং প্রসেসে ছিল দল। আর তাছাড়া ভারতের কন্ডিশনে ভালো করা যে কোন দলের জন্য কঠিন। সময়,অভিজ্ঞতা এবং কন্ডিশন বিবেচনায় বেনিফিট অব ডাউট দেওয়াই যায়।

কিন্তু, সবচেয়ে বেশি আশাহত হয়েছি অস্ট্রেলিয়াতে গত বছর ৩-০ তে হেরে যাওয়ার পর। অন্তত একটা ম্যাচ জেতা, এমনকি ফাইট পর্যন্ত করতে পারেনি দল। এই টেস্ট দলের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এটাই। কিন্তু এই দল যে দেশের বাইরে কিছু জেতে নাই তাও কিন্তু না। আরব আমিরাতে যেয়ে পাকিস্তানকে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ হারিয়েছে। গত ১০ বছরে শ্রীলঙ্কার পর নিউজিল্যান্ড দ্বিতীয় দল হিসেবে যেটা করেছে। শ্রীলঙ্কাতে এখন যত দুর্বল দলই হোক, ঘরের মাঠে কঠিন প্রতিপক্ষ। সেখানে গত বছর ২ টেস্টের সিরিজ ১-১ এ ড্র করেছে।

সবচেয়ে বড় কথা নিউজিল্যান্ডের সীমাবদ্ধতা আছে। চাইলেই ভালো করা যায় না। বছরে টেস্ট খেলে হাতে গোনা ৭-৮টা। সেই সবই হোম সামারে। দুই ম্যাচের হোম সিরিজ। বড়জোর তিন ম্যাচ। দেশের বাইরে বড় সিরিজ খেলার সুযোগ হয় কালেভদ্রে। যেমন, ভারত দুই বছর পর পর অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ড সফর করছে। নিউজিল্যান্ড শেষ ইংল্যান্ড সফর করেছে ২০১৫ তে। অস্ট্রেলিয়াতে গত বছর খেলেছে ৭-৮ বছর পর। অর্থাৎ নিউজিল্যান্ড বাইরে যাওয়ার সুযোগ পায় না। যদিও বা পায় সেটা ২-৩ ম্যাচের সিরিজ।এই সিরিজগুলোতে ভালো করা কঠিন। কারণ বড় সিরিজে কামব্যাক করার সুযোগ থাকে,নিজেকে প্রস্তুত করার সময় পাওয়া যায়। যেটা নিউজিল্যান্ডের খেলোয়াড়রা পান না।

আজকে এই দলটা তাদের ইতিহাসে প্রথমবার র‍্যাংকিংয়ে শীর্ষে উঠলো। হয়তো খুব অল্প সময়ের জন্য। কিন্তু তারপরও এই মুহূর্তটা উপভোগ করার মত। একটা দল নিজেদের সীমিত সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে, সামর্থ্যের সবটুকু নিংড়ে দিয়ে এতদূর এসেছে। শুধু এই জন্যই দলটা বাহবা পেতে পারে।

নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট কেন উইলিয়ামসনকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলো, আজকে সেটা বাস্তব হওয়ার কথা। নিউজিল্যান্ড এখন ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত সংস্করণে পৃথিবীর এক নম্বর দল – এই কথাটা বলতে অপেক্ষা আর মাত্র একটা ম্যাচের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link