ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম ‘অর্জুন’ তিনি। তবে অবাক করা হলো, জন্মসূত্রে তিনি ভারতীয় নন। কিন্তু তারপরও ভারতের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে তিনি সর্বোচ্চ ক্রীড়া স্বীকৃতি ‘অর্জুন’ সম্মাননা পেয়েছিলেন। কারণ আফগানিস্তানের কাবুল শহরে এ ক্রিকেটারের জন্মস্থান হলেও বাইশ গজের ক্রিকেটে বিচরণ ঘটিয়েছিলেন ভারতের হয়ে। বলছি সেলিম দুরানির কথা।
আশি দশকের মন্থর গতির ক্রিকেটে একটু প্রাণ ফিরিয়েছিলেন ক্যারিবিয়ান ব্যাটার ভিভ রিচার্ডস। মাঠে আসা দর্শকদের মাতিয়ে রাখতেন তাঁর খুনে মেজাজের ব্যাটিংয়ে। সময়ের পরিক্রমায়, সেই ভিভ রিচার্ডসকেই এখন ক্রিকেটের আদি হিটারের তকমা দেওয়া হয়। তবে তারও আগে থেকে আরো অনেকেই আগ্রাসী ব্যাটিং করতেন। ভারতীয় ক্রিকেটে আক্রমণাত্বক ব্যাটিংয়ের এই ধারাটা এসেছিল সেলিম দুরানির বদৌলতে।
ভারতের হয়ে ক্যারিয়ারে ২৯ টা টেস্ট খেলেছেন বাঁহাতি এ অলরাউন্ডার। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৩- ১৩ বছরের এ ক্যারিয়ারে দুরানি তাঁর নিজস্বতায় সময়ের চেয়েও এগিয়ে ছিলেন। সে সময়ের তুলনায় অনেক আগ্রাসী এক ব্যাটার ছিলেন তিনি। নিজের দিনে সেরা সব বোলারদের ওপর বইয়ে দিতেন ঝড়।
কথিত আছে, সমর্থকদের অনুরোধে ছক্কা মারতেন এ ব্যাটার। খেলোয়াড়ি জীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর দুরানি সেই কথা নিজেও জানিয়েছিলেন। তাঁর ভাষ্যমতে, এমন ছয়/সাতবার হয়েছে যখন তিনি মাঠে থাকা দর্শকদের অনুরোধে ছক্কা মেরেছেন।
জন্মসূত্রে ভারতীয় নন, তারপরও ভারতের সাথেই বাইশ গজের পথচলা। কিভাবে? কাবুলে জন্ম নিলেও এ অলরাউন্ডার খুব ছোটবেলাতেই চলে এসেছিলেন ভারতের গুজরাটে। আর সেখান থেকেই মূলত ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয় দুরানির। প্রথমে ক্লাব ক্রিকেট, এরপর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। পর্যায়ক্রমে ভারতের ক্রিকেট অন্দরমহলে ঢুকতেও তেমন কালক্ষেপণ হয়নি দুরানির।
১৯৬০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় দুরানির। অবশ্য সবার নজরে পড়েন নিজের দ্বিতীয় সিরিজে। ১৯৬১-৬২ মৌসুমে ভারত সফরে এসেছিল ইংল্যান্ড। সেবার ইংল্যান্ডকে বলতে গেলে একাই গুড়িয়ে দিয়েছিলেন দুরানি। তবে ব্যাট হাতে নয়, স্পিন ঘুর্ণিতে ভারতের দুই ম্যাচ জয়েই রেখেছিলেন অবদান।
কলকাতায় হওয়া সে সিরিজের প্রথম টেস্টে নিয়েছিলেন ৮ উইকেট। এরপর চেন্নাই টেস্টে আবারো দুরানি ঝলক। ক্যারিয়ার সেরা বোলিংয়ের দেখা পেলেন এ টেস্টেই। দুই ইনিংস মিলিয়ে নিলেন ১০ টি উইকেট। সবমিলিয়ে সে সিরিজে ২৩ টি উইকেট নিয়ে ভারতের সিরিজ জয়ের নায়ক ছিলেন দুরানি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ভারতের প্রথম টেস্ট জয়েও ছিল দুরানির বড় অবদান। ১৯৭১ সালের সেই ত্রিনিদাদ টেস্টে তিনি আউট করেছিলেন ক্লাইভ লয়েড ও ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক গ্যারি সোবার্সকে। দুরানির সেই ব্রেক থ্রুতেই ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথমবারের ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে জয় পায় ভারত।
সেলিম দুরানি তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার দর্শকদের ভালোবাসায় কতটা সিক্ত ছিলেন তা উপলব্ধ হবে ১৯৭৩ সালের এক ঘটনা টেনে আনলে। সেবার ভারত সফরে এসেছিল ইংল্যান্ড। ভারতের দলে যথারীতি ছিলেন দুরানিও। প্রথম টেস্টে দুরানি খেললেন তাঁর স্বভাবজাত ইনিংস, দ্রুত গতিতে ফিফটি তুলে নিলেন। চেন্নাইতে হওয়া পরের টেস্টেও খুব খারাপ করলেন না। দুই ইনিংসেই ৩৮ ও ৩৮।
কিন্তু অদ্ভুত কোনো কারণে কানপুর টেস্টের একাদশে তাঁকে আর রাখা হলো না। ব্যাস। বিতর্ক শুরু এখানেই। সমর্থকদের তোপের মুখে পড়ে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। শুধু সেখানেই শেষ নয়। দুরানির জন্য প্রতিবাদেও শামিল হয় সমর্থকরা। পরের টেস্টে কানপুরের গ্যালারিতে প্রতিবাদ স্বরূপ একটি প্ল্যাকার্ড নিয়ে যায় দর্শকরা। আর সেই প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘নো নুরানি, নো টেস্ট।’
সমর্থকদের এমন তোপের মুখে পড়ে পরের টেস্টেই দুরানিতে খেলাতে বাধ্য হয় ভারত। দুরানি সেই টেস্ট দিয়ে ফেরেনও দুর্দান্তভাবে। প্রথম ইনিংসে খেলেন ৭৩ রানের দুর্দান্ত একটি ইনিংস। এরপর দ্বিতীয় ইনিংসেও হেঁটেছিলেন ফিফটি পথে। তবে শেষ পর্যন্ত ৩৭ রানে থামতে হয়েছিল তাঁকে। অবশ্য দুরানির প্রত্যাবর্তনের সে টেস্টটাই হয়ে যায় তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট। মুম্বাইয়ের সে টেস্টের পর আর ভারতের হয়ে মাঠে নামা হয়নি তাঁর।
অবশ্য ক্রিকেট পাঠ চুকিয়ে এরপর দুরানি পদার্পণ করেছিলেন চলচ্চিত্রের রঙিন দুনিয়ায়। ১৯৭৩ সালে বলিউডে একটি সিনেমায় অভিনয়ও করেছিলেন, যেখানে তাঁর বিপরীতে ছিলেন সে সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী পারভিন ববি।
২৯ টেস্টে এক সেঞ্চুরিসহ ১২০২ রান আর ৭৫ উইকেটের মালিক সেলিম দুরানি। এর পাশাপাশি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৮৫৪৫ রান ও বল হাতে ৪৮৪ টি উইকেট নিয়েছেন এ অলরাউন্ডার।
পরিসংখ্যান বিবেচনায়, দুরানি গড়পড়তা ক্রিকেটারদের তালিকাতেই হয়তো থাকবেন। কিন্তু পরিসংখ্যান দিয়ে এ ক্রিকেটারকে মাপা শুধু কঠিনই নয়, দুরুহ ব্যাপারও বটে। কারণ সে সময়ের ক্রিকেটে দুরানি মানেই ছিল ক্রিকেট মাঠে দুরন্ত বিচরণ।
দুরানির ব্যাটিং তোপে সাদা যুগের ক্রিকেট টা তখন রঙিন পথে রূপ নিচ্ছিল। মন্থর গতির ক্রিকেট একটু একটু করে গতিময়তা পাচ্ছিল। ক্রিকেটের এমন যুগান্তকারী পরিবর্তন যাত্রার রূপকার তো ছিলেন এই সেলিম দুরানিই। ভারতের ক্রিকেটে যার নামটাই একটা সোনায় মোড়ানো ইতিহাস।