আসলেই কি বাংলাদেশি বলে আইপিএলে অবহেলিত আশরাফুল-লিটনরা!

‘কথা দিয়েও কথা রাখেননি সৌরভ গাঙ্গুলি’ – মোহাম্মদ আশরাফুলের এমন মন্তব্যে যেন বাংলাদেশি সমর্থকদের একটা ধারণা আরো পোক্ত হলো। সেই ধারণাটি হলো,শুধুমাত্র বাংলাদেশী বলেই আইপিএল সহ অন্যান্য ফ্রাঞ্চাইজি লিগ গুলোতে মূল্যায়ন করা হয় না এদেশের ক্রিকেটারদের। ধারণাটা আসলে কতটুকু যুক্তিযুক্ত। আসলেই শুধুমাত্র বাংলাদেশী পরিচয়ের জন্য আইপিএলে পর্যাপ্ত সুযোগ পাননি মোহাম্মদ আশরাফুল, লিটন দাসরা?

ক্রিকেটে ফ্রাঞ্চাইজি লিগের ধারণা এসেছে ১৬ বছর হতে চলল। কিন্তু বাংলাদেশের হাতে গোণা কয়েকজন ক্রিকেটার ছাড়া বিদেশের ফ্রাঞ্চাইজি লিগ গুলোতে সুযোগ পেয়েছেন খুব কম ক্রিকেটারই। যদিও ফ্রাঞ্চাইজি লিগ গুলোতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ের মত দেশের ক্রিকেটাররা। কিন্তু বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান ছাড়া কেউই ফ্রাঞ্চাইজি কোনো আসরে নিয়মিত খেলতে পারেননি।

বাংলাদেশী ক্রিকেটার আর ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের আলোচনাটা নতুনভাবে আলোচনায় আসে মোহাম্মদ আশরাফুলের সাক্ষাৎকারের পর। সেই সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ আশরাফুল বলেন, তখনকার কলকাতা নাইট রাইডার্স অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি তাকে কথা দিয়েছিলেন আইপিএলের নিলামে দলে ডাকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই নিলামে কলকাতা বা অন্য কোনো ফ্রাঞ্চাইজিই দলের ডাকেনি আশরাফুলকে।

এখন এখানে বোঝার বিষয় হলো সৌরভ গাঙ্গুলি যদি আশরাফুলকে দলে ডাকতে চানও তবুও দলে ডাকতে না পারার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ কোনো খেলোয়াড়কে দলে ডাকতে ফ্রাঞ্চাইজি মালিক ও টিম ম্যানেজমেন্টের সম্মতিও প্রয়োজন। সবার সম্মতি মিলিয়েই দলে ডাকা হয় একজন ক্রিকেটারকে। তাই আশরাফুলের এমন অভিযোগ ধোপে টেকে না বলা যায়।

পরের মৌসুমেই মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে আইপিএল খেলার সুযোগ পান আশরাফুল। তারকায় ঠাসা মুম্বাই দলে তখন বিদেশী কোটায় দলে সুযোগ পাওয়াই কঠিন। তবে সুযোগ পেয়েও সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি আশরাফুল। নিজের পছন্দের চার নম্বর পজিশনে ব্যাট করতে নেমে দশ বলে দুই রান করে আউট হন একটা নির্বিষ বলে। জয়সুরিয়া, ডুমিনি, ডোয়াইন ব্রাভো, কাইল মিলসদের নিয়ে তারকায় ঠাসা মুম্বাই দলে আশরাফুলের আরেকটি সুযোগ পাওয়া তাই কঠিনই ছিল।

এদিকে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে আইপিএলে সুযোগ পেয়েছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। কিন্তু রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর হয়ে একটি ম্যাচে সুযোগ পেয়ে সুযোগের ব্যবহার মোটেই করতে পারেননি রাজ্জাক। দুই ওভার বল করে ২৯ রান দেন রাজ্জাক। একই পরিণতি ছিল কলকাতার হয়ে আইপিএলে খেলতে যাওয়া মাশরাফি মোর্তজারও। কিছু দিন আগেই রিঙ্কু সিংয়ের কাছে পাঁচ ছক্কা হজম করা ইয়াশ দয়ালের আগে আইপিএলে শেষ ওভারে সবচেয়ে বেশি রান হজম করার রেকর্ড ছিল মাশরাফিরই।

ভারতীয় খেলোয়াড় হয়েও ইয়াশ দয়াল যেখানে সেই ম্যাচের পর আর একাদশে ফিরতে পারেননি সেখানে মাশরাফি, রাজ্জাকদের মত বিদেশী ক্রিকেটারদের জন্য আরেকটা সুযোগ পাওয়া ছিল আরো কঠিন।

বাংলাদেশীদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন সাকিব আল হাসান ও মুস্তাফিজুর রহমান। নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ রেখে ২০১২ সাল থেকে প্রায় প্র‍তি বছরে আইপিএলে খেলেছেন সাকিব। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক অভিষেকেই সাড়া ফেলে দেয়া মুস্তাফিজও সানরাইজার্সের হয়ে পুরো মৌসুম খেলেছেন।

দলকে শিরোপা জেতানোর পাশাপাশি জিতেছেন প্রথম বিদেশী হিসেবে সেরা নবীন খেলোয়াড়ের পুরষ্কারও। আন্তর্জাতিক অভিষেকের মাত্র সাত মাসের মাথায়ই আইপিএলে দল পান মুস্তাফিজ। বাংলাদেশী বলে তাকে অবহেলা করা হয়নি মোটেও।

এবারের আসরে গুজরাটের হয়ে আইপিএল খেলা আফগান রিস্ট স্পিনার নুর আহমেদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খুব দারুণ কিছু না করলেও তাঁর সামর্থ্যের ওপর আস্থা রেখেছে গুজরাট। তারা দলে নিয়েছে আইরিশ পেসার জশ লিটলকেও।

এবারের আসরে প্রথমবারের মত সুযোগ পাওয়া লিটন দাসের ক্ষেত্রেও ঘটেছে আশরাফুল-মাশরাফিদের মত ঘটনা। লিটনের টি-টোয়েন্টি রেকর্ড আহামরি না হলেও শুধুমাত্র টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে লিটনের সামর্থ্যে আস্থা রাখে কলকাতা।

শুরু থেকেই আইপিএলে খেলার অনাপত্তিপত্র পেলে হয়তো রহমানুল্লাহ গুরবাজের আগেই কলকাতা একাদশে সুযোগ পেতেন লিটন। কিন্তু তিন ম্যাচ পর দলের সাথে যোগ দেয়ায় ততক্ষনে দলে জায়গা পেয়ে সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফেলেছেন গুরবাজ।

যদিও সুযোগ পেয়েছিলেন লিটন। কিন্তু আইপিএল অভিষেকটা লিটনের হয়েছে ভুলে যাবার মত। ব্যাটিংয়ে নেমে যাচ্ছেতাই শট খেলে আউট হবার পর উইকেট কিপিংয়ে মিস করেছেন সহজ দুটি সুযোগ। এমন হতাশাজনক পারফরম্যান্সের পর লিটন আরেকটি সুযোগ হয়তো ডিজার্ভও করেন না।

তাছাড়া টুর্নামেন্টের শেষ দিকে দলের সাথে থাকবেন না লিটন। এমন পরিস্থিতিতে পুরো মৌসুম দলের সাথে থাকা গুরবাজকেই কলকাতা থিতু করতে চাইবে সেটিই স্বাভাবিক।

ওয়ানডে ফরমেটে ভয়ংকর দল হয়ে উঠলেও টি-টোয়েন্টি ফরমেটটা এখনো ভালো খেলে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। ২০০৭ সালের পর বিশ্ব আসরে হারাতে পারেনি কোনো বড় দলকে। এমন পরিস্থিতিতে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশী খেলোয়াড় নিয়ে বিশ্বজুড়ে ফ্রাঞ্চাইজিদের নেতিবাচক ধারণা থাকাই স্বাভাবিক।

তাছাড়া ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটটাই পারফরম্যান্স এর ওপর চলে। তাই পারফর্ম না করলে সে কেউই দয়া দেখাবে না কারো প্রতি। কারণ দিনশেষে ফ্রাঞ্চাইজিদের জন্য এটা একটা বিজনেস প্রজেক্ট।

ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে বাংলাদেশী ক্রিকেটারদের দুরবস্থার আরেকটি কারণ হলো বাংলাদেশে বিশ্বমানের কোচের অভাব। র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যাদের কোনো কোচই বিদেশে ফ্রাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে কোচিং করান না। যখন কোনো বিদেশী কোচ আইপিএলে কোচিং করাতে আসেন তখন স্বাভাবিক ভাবেই খেলোয়াড় বাছাইয়ের সময় তিনি তাঁর দেশের খেলোয়াড়দের একটু হলেও এগিয়ে রাখবেন। ঠিক এ জায়গাটেই যোজন যোজন পিছিয়ে বাংলাদেশ।

ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট আর জাতীয় দল এক নয়। এখানে কাউকে সুযোগ দিয়ে গড়ে তোলার কিছু নেই। তাই নিউজিল্যান্ডের বিধ্বংসী ব্যাটার ফিন অ্যালেনকেও তিন মৌসুম ডাগ আউটে বসে থাকতে হয় সুযোগের অভাবে। তাই শুধুমাত্র বাংলাদেশী পরিচয়ের জন্য লিটনদের অবহেলা করা হচ্ছে এটা অবান্তর ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link