একজন আগাগোড়া ফুটবলপ্রেমী হিসাবে আমার সবচেয়ে কষ্টের জায়গাটি হলো বাংলাদেশ ফুটবল। লজ্জাজনক হলেও সত্যি গত দুই দশকে ফুটবল র্যাংকিংয়ে আমাদের অবস্থান সবার তলানিতে। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের জাতীয় খেলা কাবাডি আর ক্রীড়া উন্মাদনার জায়গা ক্রিকেট হলেও ভালবাসার একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে ফুটবল।
অথচ এই ফুটবল নিয়ে আমাদের একটি স্বর্ণালী অতীত ছিলো। একসময় বাঙালির রক্তের সাথে মিশে ছিলো ফুটবল। বৃহত্তর এশিয়া পর্যায়ে সফল না হলেও অন্তত দক্ষিণ-এশিয়ার ফুটবলে আমাদের দাপট ছিলো। সাফ ফুটবল কিংবা দক্ষিণ এশিয়া গেমসে অন্তত শিরোপা জয় করার যোগ্যতা ছিলো এবং জয়ও করেছি।
বর্তমান সময়ে আমরা যেমন রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সালোনা ‘এল ক্লাসিকো’ ম্যাচ নিয়ে উন্মাদনায় মেতি উঠি, তেমনি ৯০’ এর দশকে বাঙালি আবাহনী-মোহামেডান এর ‘ঢাকা ডার্বি’ ম্যাচ নিয়ে উন্মদনায় মেতে উঠতো। পুরো দেশ দুই দলের সমর্থনে বিভক্ত হয়ে যেতো। প্রত্যেকটি পাড়া-মহল্লায় অলিতে গলিতে ছেয়ে যেত দুই ক্লাবের নীল-হলুদ আর সাদা-কালো পতাকায়। খেলা চলাকালীন সময়ে টেলিভিশন কিংবা রেডিওর সামনে পুরো দেশজুড়ে থাকতো পিনপতন নীরবতা।
আর ঢাকা শহরে অনেকটা ঈদের আমেজ লেগে যেতো। সমর্থকদের প্রিয় দলের জার্সি গায়ে বঙ্গবন্ধু ফুটবল স্টেডিয়াম গ্যালারী কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যেতো। সমর্থকদের মাঝে যাতে ঝামেলা সৃষ্টি না হয় সেজন্য মাঠের এক পাশে বসতো আবাহনী সমর্থকরা অন্যপাশে বসতো মোহামেডান সমর্থকরা। পুরো স্টেডিয়াম যেন একটি অঘোষিত রণক্ষেত্র। ম্যাচশেষে জয়ী দলের উল্লাসের পাশাপাশি মাঝেমাঝে অনাকাঙ্খিত সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটতো।
তখন বাংলাদেশ ফুটবলে ছিলো অসংখ্য তারকা খেলোয়াড়। মোনেম মুন্না ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। মোনেম মুন্না শুধু বাংলাদেশের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। তার চোখ ধাঁধানো নৈপুণ্যময় খেলা এবং জাতীয় দলের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে তিনি বাংলাদেশের ফুটবল আইকনে পরিণত হয়েছিলেন। সেই ১৯৯১ সালে রেকর্ড ২০ লক্ষ টাকায় তিনি আবাহনীর সাথে চুক্তি করেছিলেন। তখনকার বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের জার্মান কোচ অটো ফিস্টার মোনেম মুন্না সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘He was mistakenly born in Bangladesh.’
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাঙালির একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম ছিলো ফুটবল। আর এই ফুটবলের গোড়াপত্তন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু নিজেও তরুণ বয়সে অসাধারণ ফুটবল খেলতেন। ১৯৭২ সালে ফুটবল ফেডারেশন গঠনের পর তিনি নিজে ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্বাধীন বাংলায় প্রথম ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করেন। তিনি নিজে সেই ম্যাচ মাঠে বসে থেকে উপভোগ করেছেন।
এছাড়াও বাংলাদেশের সাথে ছোট-বড় সব দলের খেলা স্বশরীরে মাঠে উপস্থিত থাকতেন। বাংলাদেশ দল কোনো আন্তর্জাতিক সফরে গেলে ধানমন্ডি ৩২-এ অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে যেতেন। শেষবার ১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ার মারদেকা ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে যাওয়ার সময় জাতীয় দলের খেলোয়াড়দেরকে বলেছিলেন, ‘ভাল করে খেলবি, স্বাধীন দেশের মান-সম্মান যেন থাকে। আমি কিন্তু খেলাধুলার সব খবর রাখছি।’
এছাড়াও জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন লেখায় বাঙালির ফুটবল প্রীতি সম্পর্কে আঁচ করা যায়। ছেলেবেলায় শংকর নামে হুমায়ূন আহমেদের এক বাল্যবন্ধু ছিলেন। শৈশবে তাঁদের দু’জনেরই পড়াশোনায় একদম মনোযোগ ছিলো না। কিন্তু ক্লাস থ্রির বার্ষিক পরীক্ষার আগে ঘটল একটা ব্যতিক্রম ঘটনা। কারণ বন্ধু শংকরের মা ঘোষণা দিলেন, ‘শংকর যদি ক্লাস থ্রি পাস করে ফোরে উঠতে পারে তবে সে পাবে একটা ফুটবল।’
একটা চামড়ার ফুটবলের ভীষণ শখ তাঁদের। ফুটবলের লোভে শংকরকে নিয়ে পড়তে বসল তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র হুমায়ূন। একই ক্লাসে পড়লেও তখন হুমায়ূন শিক্ষক আর শংকর ছাত্র। কিন্তু পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পর দেখা গেল হুমায়ূন প্রথম হলেও শংকর পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। সেবার পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েও ফুটবল না পাওয়ার দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরেছিল ছোট্ট হুমায়ূন।
পথিমধ্যে হুমায়ূনের কান্না দেখে হেডস্যারের ভীষণ মায়া হয় এবং যার ফলে শংকরকেও প্রমোশন দেওয়া হয়। এরপর শংকরের মা তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এক নম্বুরি ফুটবল কিনে দেয় শংকরকে। সেই ফুটবল দিয়ে হুমায়ূন ও তার বন্ধুরা শৈশবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ‘গ্রীনবয়েজ ফুটবল ক্লাব’।
নেদারল্যান্ডের এক ভদ্রলোক একবার হুমায়ূন আহমেদকে বলেছিলো, ‘তোমরা এই ফুটবল খেলাটা খেলতে পারো না। তারপরেও এই খেলার প্রতি তোমাদের এত মমতা কেন? কারণটা কি?’
হুমায়ূন আহমেদ জবাবে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ মানেই বর্ষা, আর বর্ষা মানেই ফুটবল।’
ভদ্রলোক কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘তার মানে?’
হুমায়ূন আহমেদ কথার পাত্তা না দিয়ে বলেছিলেন, ‘মানে তুমি বুঝবে না। বাদ দাও।’
আসলে ভিনদেশীর সাথে হুমায়ূন আহমেদের অহেতুক কথা বাড়াতে ইচ্ছা হয়নি। কারণ ফুটবল ছিলো আমাদের আবেগ আর ভালবাসার জায়গা। আবেগ আর ভালবাসার জায়গা কি আর কোনো কারণ দ্বারা দর্শানো যায়!
ফুটবল নিয়ে আমাদের গৌরবউজ্জল অতীত থাকলেও বর্তমান সময়ে পরিস্থিতি তার ঠিক বিপরীত। সবকিছু যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। স্কুল পর্যায়ের ফুটবল থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের ফুটবল কোনো কিছুই যেন ঠিক নেই। মাঠ পর্যায় থেকে দক্ষ খেলোয়াড় বাছাই এবং তৈরী করার কোনো বালাই যেন। দেশসেরা ক্লাবগুলোর আগের মত জৌলুসতা নেই। নিম্নমানের খেলায় ফুটবল মাঠে দর্শকের কোনো উপস্থিতি নেই।
সত্যি বলতে আমাদের ফুটবল প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন’ গোড়ায় গলদ রয়েছে। আমাদের বাফুফে যেন উদ্ভট এক ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন এই প্রতিষ্ঠানের ডিকটেটর হিসাবে আর্বিভূত হয়েছেন। বিগত ১৬ বছর যাবত উনি কিভাবে দেশের বৃহত্তর ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং প্রতিষ্ঠানের কি উন্নতি সাধন করেছেন সেটা তিনি নিজেই ভালো জানেন!
অন্যদিকে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলোর বেহাল দশার কথা বলতে লজ্জা হয়। যেখানে ফুটবল নিয়ে আলোচনা হবে, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ হবে, পরিকল্পনা হবে সেখানে অবৈধ ক্যাসিনো, মাদক আর দেহ ব্যবসায় সকাল-দুপুর মত্ত্ব থাকে। দুঃখের বিষয় এই যে বঙ্গবন্ধু যে ক্লাবের হয়ে ফুটবল মাঠ মাতিয়েছেন সেই ঐতিহ্যবাহী ‘ওয়ান্ডার্স ক্লাব’ অবৈধ কর্মকাণ্ড থেকে রেহাই পায়নি।
বাংলাদেশ ফুটবলের এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের কিছু অগ্রদূত প্রয়োজন। গত বেশ কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার সুমনকে দেখলাম ফুটবল নিয়ে কাজ করতে। ফুটবলের জন্য তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি ফাউন্ডেশনও গঠন করেছেন।
কিন্তু হতাশার বিষয় এই যে, আমরা অনেকে উনার ফুটবল কর্মকান্ড নিয়ে হাসি-তামাশা এবং ট্রল করে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করছি। কেউ যদি কোনো অন্যায় করে তার জন্য যেমন সমালোচনার প্রয়োজন আছে। তেমনি ভালো কাজ করলে অবশ্যই সেটা প্রশংসার দাবীদার। তার প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে তাকে হয়তো উৎসাহ না দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে তাকে নিরুৎসাহিত করবেন না। উনি ফুটবল নিয়ে এসব কাজ লোক দেখানো উদ্দেশ্যে করুক আর ভিন্ন উদ্দেশ্যে করুক; নিঃসন্দেহে এটা আমাদের ফুটবলের জন্য সামান্য হলেও উপকার বয়ে আনবে।
আমি চাই ব্যারিস্টার সুমনের মত স্বাবলম্বী আরো একশো জন ফুটবল প্রেমী বাংদেশের ফুটবল উন্নয়নে এগিয়ে আসুক। দেশের ফুটবলকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিক। আমাদের প্রতিভার ঘাটতি নেই, অভাব শুধু সুযোগের।
সবশেষে হুমায়ূন আহমেদের মত বলতে চাই, ‘সবাই বলে আমাদের শারীরিক যোগ্যতা নেই। আমাদের দম থাকে না। তার মানে কি? ফুটবল খেলতে হলে দৈত্য হতে হবে? আর আমাদের দম না থাকলে কাদের থাকবে? সবাই বলে আমাদের খেলোয়াড়রা ফুটবলের আধুনিক কৌশল জানেন না। কৌশল জানেন না, শিখবেন। আমরা কি বেকুবের জাত যে শিখতেও পারব না?’’
বাংলাদেশ ফুটবল নিয়ে আমার আজন্ম একটা স্বপ্ন আছে। জানিনা এই স্বপ্ন কখনো পূরণ হবার নাকি। তবু স্বপ্ন দেখতে দোষ কি!
বাংলাদেশ একদিন বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশগ্রহণ করবে। খেলার শুরুতে সবাই জাতীয় সংগীত গাইতে থাকবে। তখন আনমনে আমি দাঁড়িয়ে যাবো, গায়ের লোমগুলো হয়তো দাড়িয়ে যাবে, আমার দু’চোখ বেয়ে পড়বে শত আনন্দের অশ্রুধারা, বুকে হাত রেখে তাল মিলিয়ে গাইতে থাকবো – ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি!’