ফুটবলে প্রচলিত একটা কথা আছে। মাঝমাঠ যারা দখলে রাখতে পারবে, ম্যচ তাদের। শতবর্ষের ইতিহাসে কথার সত্যতা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সহস্রবার। রণক্ষেত্রে গোলরক্ষক কিংবা গোলদাতা যতখানি পাদপ্রদীপের আলোয় আসে, রক্ষণসৈন্যদের নিয়ে যত চর্চা হয়, তুলনায় ঢের কম শব্দ খরচ হয় মিডফিল্ডারদের নিয়ে। কিন্তু কোচের রণকৌশলে ওরাই অগ্রনায়ক। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা নায়কদের ওই দলে মহানায়কের খেতাব পাবেন। তিনি গ্যাব্রিয়েল মার্কেজের সাহিত্য, হুডিনির মায়াজাল, ভ্যান গগের রংতুলির মিশেলে তৈরি স্প্যানিশ ম্যাটাডোর।
প্রায় আড়াই দশক আগের এক সংবাদ সম্মেলনে ঘুরে আসা যাক। যেখানে কাতালান ক্লাব বার্সেলোনার মধ্যমাঠের সেরা অস্ত্র জোসেফ গার্দিওলা উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকদের একটি প্রশ্ন ছিল এমন, ‘আপনার কি মনে হয় আপনার পর বার্সা এবং ফুটবলবিশ্ব পেতে যাচ্ছে জাভির মত একজন উত্তরসূরীকে?’ গার্দিওলার জবাব শুনুন, ‘নি:সন্দেহে জাভি অসাধারণ। তবে আমার মনে হয় জাভি নয়, ইনিয়েস্তা একদিন শাসন করবে ফুটবলবিশ্ব!’
শাসন না হোক, গার্দিওলার কথার সত্যতা পেয়ে গেছে বিশ্ববাসী! কী আছে ইনিয়েস্তার খেলায়? এই প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে বরং খুঁজুন কী নেই। আপনি হাঁপিয়ে যাবেন, কিন্তু সমাধান পাবেন না। বার্সায় খেললেও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থকরা যখন বার্নাব্যুতেই কাউকে বিশেষভাবে সম্মানিত করে, তার নামে জয়োধ্বনি তোলে তখন বুঝতে হবে জাদুকরের বিশেষত্ব।
২০০৯ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমির দ্বিতীয় লেগে চেলসির বিপক্ষে গোলের জন্য মরিয়া থেকেও চেককে ফাঁকি দিতে ব্যর্থ মেসি ইতোরা। ত্রাতার ভূমিকায় ইনিয়েস্তা। শেষমূহুর্তে চোখধাঁধানো গোল এবং বার্সা ফাইনালে! সেই গোলের পর হলুদ জার্সি খুলে তা ঘুরাতে ঘুরাতে তার উদ্যাম দৌঁড় ফুটবলপ্রেমীরা মনে রাখবে অনেক অনেক দিন। ম্যাচটি নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, ইনিয়েস্তার গোল নিয়ে নেই। সেই এক গোলের সুবাদে খুলে যায় বার্সার শিরোপা দুয়ার, যে দুয়ার দিয়ে একে একে ন্যু ক্যাম্পে পেপ অ্যান্ড কোং নিয়ে যায় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, উয়েফা সুপার কাপ আর ক্লাব বিশ্বকাপ।
সেই বছরের সর্বজয়ী বার্সা টিমের সাফল্যের কৃতিত্ব কাকে দেবেন? লিওনেল মেসি? পর্দার আড়ালে পুতুল নাচানো পেপ গার্দিওলা? নাকি এটাকে সম্মিলিত প্রচেষ্টা বলবেন?
বলতে পারেন ইচ্ছেমত। একবছরে ছয় ছয়টি শিরোপা জেতা চাট্টিখানি কথা নয়, ইতিহাসে এমনটা পারেওনি কেউ। তবে এর অন্যতম অগ্রনায়ক যে ‘আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা লুহান’ তা অস্বীকার করবে না কেউ।
বার্সার লা মাসিয়া নামক মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র ‘ডন’ ডাক নামের ইনিয়েস্তা। শেষ সময়ের গোলে প্রতিপক্ষের হৃদয় চুরমার করে দেন বলে ‘হার্টব্রেকার’ নামে আরেকটি ডাকনামও আছে ১৯৮৪ সালের ১১মে স্পেনের ফুয়েঞ্চেলবিল্লায় জন্ম নেওয়া পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির এই তারকার। শেষ মূহুর্তে গোল দিয়ে কেবল চেলসিকে নয়, কাঁদিয়েছিলেন নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলকে, তাও বিশ্বকাপের ফাইনালে! ১১৮ মিনিটে দেওয়া কোনাকুনি শটের দৃষ্টিনন্দন গোল স্পেনের ট্রফিকেসকে সমৃদ্ধ করেছে আর স্প্যানিশদের এনে দিয়েছে গর্বের উপলক্ষ্য।
ছোটবেলায় ইনিয়েস্তাকে সবাই দলে নিতে চাইত। চাইত সে গোল করুক। সে গোল করা মানে না হারার নিশ্চয়তা। ক্যারিয়ারের একদম শেষতক ব্যাপারটা বহাল থাকে। বার্সায় করা ৩৮ আর লা রোজাদের জার্সিতে করা ১৩ গোলের ম্যাচগুলোয় আন্দ্রেস মাঠ ছেড়েছে মাথা উঁচু করে। পাস ক্রিয়েট, চান্স ক্রিয়েট শব্দগুলি যদি হয় ফুটবলের কবিতা, ইনিয়েস্তা তাহলে কবি। গার্দিওলার হাত ধরে গত দশকের শেষ সময়ে সবুজ গালিচায় তিকিতাকার জয়োধ্বনি উঠেছিল, তাতে সুরের ঝংকার তোলার প্রধান কারিগর তো ছিল এই ছেলেটাই।
ফার্নান্দো তোরেস একবার বলেছিল, ‘ইনিয়েস্তার পায়ে বল গেলে সময় থমকে যায়।’ সত্যিই! সাড়ে চৌদ্দ আউন্সের চর্মগোলক যেন তার অনুগত শিষ্য। যেভাবে চায় সেভাবে চালায়। স্পেনের ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো ট্রিলজির অন্যতম রূপকার ইনিয়েস্তার হয়ত খেলা হতো না দশের বিশ্বকাপই! বিশ্বকাপের আগে গোটা সিজন ঊরুর ইনজুরি ভোগায় তাকে। ভিসেন্তে দেল বস্কের কাছে গোটা ফুটবল দুনিয়া কৃতজ্ঞ থাকবে। ফিজিওর বারণ, ফিটনেসের তথৈবচ হালকে পাত্তা না দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিমানে চাপান ইনিয়েস্তাকে। গুরুর আস্থার প্রতিদান কী নিদারুণ সৌন্দর্য্যেই না দিলেন ডন আন্দ্রেস!
ফুটবলে দশ নম্বর জার্সি মানেই সর্বেসর্বা। সাত সংখ্যাকে ব্র্যান্ড বানিয়েছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। কিন্তু অসংখ্যা অ্যাকাডেমির সবুজ ঘাসে, পাড়া মহল্লার অলিগলিতে কেউ কেউ আট নম্বর জার্সি গায়ে চাপানোর স্বপ্নে বিভোর থাকে। আটের নিচে গোটা অক্ষরে দৃশ্যমান ইনিয়েস্তার নাম তাদের কাছে আদর্শ আর ভালবাসার অপর নাম।