শুভমান গিলের যম, এমএস ধোনির তুরুপের তাস

শুভমান গিল তখন পঞ্চাশের পথে এগিয়েছেন। পঞ্চাশ পেরোলেই এ ওপেনার কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেন তার নমুনা মিলেছে আগের দুই ম্যাচেই। দুই ম্যাচে গিলের শতক, আর দুটি ম্যাচেই বড় রান লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে গুজরাট টাইটান্সের জয়।

সেই ধারাবাহিকতায় প্রথম কোয়ালিফায়ারে চেন্নাই সুপার কিংসের বিপক্ষে ম্যাচেও এমন কিছুরই আভাস দিয়েছিলেন। শুভমান গিলের একার আগ্রাসনের হতবুদ্ধিতে পড়ে যায় চেন্নাইয়ের বোলাররা।

তবে, গিলকে থামাতে এর কিছুক্ষণ বাদেই উদয় হলেন দীপক চাহার। অধিনায়ক ধোনিকে ইশারায় বললেন স্কোয়ার লেগে অতিরিক্ত আরো একজন ফিল্ডারকে যোগ করতে। অধিনায়কও সেটাই করলেন। ডেভন কনওয়েকে নিয়ে আনলেন স্কোয়ার লেগে।

ব্যাস। দীপক চাহার ঐ রণকৌশলেই আটকে যান শুভমান গিল। চাহারের করা পরের স্লোয়ার বলটা উড়িয়ে ঐ স্কোয়ার লেগেই মারলেন। কিন্তু বাউন্ডারির সীমানা অতিক্রম করতে পারলেন না গিল। স্কোয়ার লেগে থাকা ফিল্ডার ডেভন কনওয়ের তালুবন্দী হলেন।

আর তাতেই ভয়ংকর হয়ে ওঠার আগে ব্যক্তিগত ৪২ রানের মাথায় সাজঘরে ফিরে যেতে হয় গিলকে। গিলের বিদায়ের পর ম্যাচেও আর ফিরে আসতে পারেনি গুজরাট। দীপক চাহারের ঐ ব্রেক থ্রুতেই ফাইনালে যাওয়ার পথ সহজ হয়ে যায় চেন্নাইয়ের।

দীপক চাহারের ক্যারিয়ারের একদম শুরুর সময়কার কোচ নাভেন্দু তিয়াগির কাছে এটা নতুন কিছু নয়। তিনি দীপক চাহারের এহেন বুদ্ধিমত্তার বোলিংয়ের সাথে পরিচিত সেই ক্যারিয়ারের আদিলগ্ন থেকেই। ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন সেই কথাই।

চাহারের এ কোচ জানিয়েছেন, ‘আপনি যদি গিলের আউটের ভিডিওটা আরো একবার দেখেন লক্ষ্য করবেন, ঐ সময়ে গিলের বাউন্ডারির প্রয়োজন ছিল। একই সাথে বাউন্ডারির মোমেন্টামেও ছিল সে। আর তখন চাহার স্কোয়ার লেগে একটা ফিল্ডার বাড়িয়ে নিয়েছে। যাতে করে ওর স্লোয়ার ডেলিভারিতে গিল ঐ প্রান্তেই মারতে উদ্যত হয়। গিলও চাহারের পাতা ফাঁদে ধরা দেয়। অথচ যে স্লোয়ারটা সে দিয়েছে, তাতে কিন্তু চাহার খুব দক্ষও না। কিন্তু ও জানে, কিভাবে নিজের দুর্বল দিককে শক্তিশালী কর তুলতে হয়।’

চাহারের একদম কৈশোর বয়স থেকে দেখে আসা কোচ তিয়াগি নিজ শিষ্যের সাফল্যে যারপরনাই খুশি। এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘সেই কবে থেকে দেখছি ওকে। এখন ও যে ভাবে নিজের বোলিংয়ের উন্নতি করেছে তা দুর্দান্ত। ওর বোলিংয়ে আগের চেয়ে অনেক অস্ত্র যোগ হয়েছে। সুইং তো আগে থেকেই ভাল পারে সে। এজন্য তাঁকে আমি চেরি বলে ডাকতাম।’

দীপক চাহারের উঠে আসার পিছনে তাঁর বাবা লোকেন্দ্র সিং চাহারের ভূমিকা অনেক। তাঁর বাবা ছিলেন আর্মি ব্যাকগ্রাউন্ডের লোক। অবাক করা ব্যাপার হলো, নিজের ছেলের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের জন্য তিনি সেই চাকরিও ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। নাভেন্দু তিয়াগির কাছ থেকে এবার সেই অজানা গল্পই বেরিয়ে এসেছে।

এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘তখন আমি দীপক চাহারের কোচ। তো ওর বাবা শুরু থেকেই অনেক শৃঙ্খলাপরায়ণ। এমন ডিসিপ্লিনে বড় হয়েছিল চাহারও। অবাক করা ব্যাপার হলো, লোকেন্দ্র সিং জি তাঁর ছেলের জন্য নেট অনুশীলনের ব্যবস্থা করেছিলেন শুরুর দিকেই। যাতে দীপক চাহার বোলিং প্র্যাকটিসটা চালিয়ে যেতে পারে।’

পরবর্তীতে ছেলেকে ক্রিকেটার তৈরি জন্য বাবা এতটাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন যে তিনি তাঁর কর্মস্থল সুরাতগড়  থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের হানুমানগড়ে যেতেন, যেখানে দীপক চাহার প্র্যাকটিস করতেন। তো সেই সময়েই নাকি আর্মির চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন লোকেন্দ্র সিং চাহার।

তাঁর একটাই কথা ছিল, ‘দীপক যদি ভারতের হয়ে খেলে, আমি চাকরি ছেড়ে দিব।’ যদিও কোচ তিয়াগি বহু বুঝিয়ে শুনিয়ে চাহারের বাবাকে শান্ত করেন। তারপরও ছেলের প্র্যাকটিস দেখার জন্য প্রতিদিন ৫০-৬০ কিলোমিটার ভ্রমণক্লান্তি আর থামাননি লোকেন্দ্র সিং চাহার।

২০১৬ সালে রাইজিং পুনে সুপারজায়ান্টসের হয়ে আইপিএল অভিষেক হয় দীপক চাহারের। চেন্নাই সুপার কিংস দুই বছর নিষেধাজ্ঞা পাওয়ায় তখন ঐ দলের অধিনায়ক হয়ে আসেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। সেই থেকে ধোনির ছায়াতলেই আছেন দীপক চাহার।

দুই বছর বাদে, ধোনি ফিরলেন চেন্নাই শিবিরে। দীপক চাহারেরও ঠাই হলো ধোনির দলেই। মূলত, গত ৬ বছর ধরেই ধোনির বোলিং লাইনআপে ধ্রুব এক অস্ত্র হয়ে উঠেছেন দীপক চাহার। একই সাথে, ধোনির আস্থাভাজনদের তালিকাতেও চলে আসেন চাহার।

এমন একটা দলের হয়ে ধারাবাহিকভাবে খেলতে পেরে চাহারও বেশ খুশি। কোচ তিয়াগিয়ের ভাষ্যে উঠে এসেছে সেই কথাই। তিনি বলেন, ‘চাহার মাঝেমধ্যেই আমাকে বলে, এখানে নিজের বোলিংয়ে অনেক স্বাধীনতা থাকে। এমনিতে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে দলগুলোর অনেক চাহিদা থাকে। কিন্তু চেন্নাই সুপার কিংস কখনো জোর করে আমার উপর কিছু চাপিয়ে দেয় নি।’

দীপক চাহার শুরু থেকেই যে ক্যারিয়ারের প্রতি সচেতন সে ব্যাপারে নাভেন্দু তিয়াগি আরো যোগ করে বলেন, ‘কত বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু চাহারের চলন বলনে একটুও পরিবর্তন দেখিনি। ও আগের মতোই এখনও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। কোনো পার্টিতে যায় না। ফোন থেকে দূরে থাকে বেশিরভাগ সময়। আর এ কারণেই তো সে ধোনির এত প্রিয়।’

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link