একুশ শতকে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা যে ক্রিকেট তাতে কারো দ্বিমত পোষণ করার কথা নয়। তাহলে লেখার শুরুতে এত ঘটা করে কেন তা বলা? বলতেই হয় কেননা একটা সময় জনপ্রিয়তা তো দূরে থাক, এদেশে ভালোভাবে পরিচিতিই লাভ করেনি ক্রিকেট। তখন পুরো বিশ্বের মতো দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। আজকের তামিম-সাকিবদের মতো তখন দেশের ক্রীড়াঙ্গনের পোস্টার বয় ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু-কাজী সালাউদ্দিনরা।
সত্তরের দশকে বাংলাদেশে ফুটবলই ছিল গণমানুষের প্রাণের খেলা। ওই সময় মানুষের আবেগের একটি বড় অংশজুড়ে অবস্থান করত ফুটবল। উৎসবের আমেজে দল বেঁধে ফুটবল খেলা দেখতে নিয়মিত মাঠে যেতেন মানুষজন। হোক জাতীয় দলের খেলা বা লিগ ফুটবল, স্টেডিয়াম থাকত কানায় কানায় পরিপূর্ণ। বেশিরভাগ সময়ই গ্যালারিতে দর্শকদের ঠাঁই দিতে বিপাকে পড়তে হতো কর্তৃপক্ষকে।
ফুটবলের ঠিক এমন স্বর্ণালি সময়ে এদেশে অবির্ভাব ঘটে ক্রিকেট নামের নতুন ও অপরিচিত একটি খেলার। ক্রিকেটকে পুরো দেশে ছড়িয়ে দিতে এবং খেলাটির প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়াতে ১৯৭২ সালে গঠন করা হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট কনট্রোল বোর্ড (বিসিসিবি) যা বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) নামে পরিচিত। ক্রিকেটের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তৈরি করতে একই বছর ঢাকা ও চট্টগ্রামে একটি ক্রিকেট লিগ আয়োজন করে বিসিসিবি যা আসলে বিরাট ধাক্কা হিসেবে আবির্ভূত হয় তাঁদের সামনে। কারণ লিগটি ক্রিকেটের প্রতি দর্শকদের উৎসাহ জাগাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। তবে সময়ের সাথে সাথে ক্রিকেট খেলাটি এদেশে পরিচিতি পেতে শুরু করে যার শুরুটা মূলত ১৯৭৭ সালে।
১৯৭৭ সালের ৭ জানুয়ারি। বরাবরের মতোই বাংলাদেশে তখন হাড় কাঁপানো শীতের প্রকোপ। এমন শীতে দেশের মানুষদের একটু উত্তাপের দরকার ছিল যা বয়ে আনে ক্রিকেট। বাংলাদেশের খেলা দেখতে এখনকার মিরপুরের শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে মানুষের যে ঢল দেখা যায় তা বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো দেখা গিয়েছিল সেদিন।
সেদিন প্রচুর দর্শক সমাগম হয়েছিল ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম)। তখনকার প্রেক্ষাপটে কোনো ক্রিকেট ম্যাচে দর্শকদের এমন সরব উপস্থিতি ছিল যারপরনাই অবাক করার মতো। সেদিন প্রায় ৯০ হাজার দর্শকের কলরবে মুখরিত হয় ঢাকা স্টেডিয়াম। কারণ সেদিনই যে মাঠে গড়ায় ক্রিকেট ইতিহাসে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ!
ম্যাচটি ছিল বাংলাদেশ ও মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি) একাদশের মধ্যকার তিন দিনের একটি ম্যাচ। ১৯৭৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর টেড ক্লার্কের নেতৃত্বে ঢাকায় পা রাখে ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি)। বাংলাদেশের বিপক্ষে মূল ম্যাচটি খেলার আগে রাজশাহী ও চট্টগ্রামে যথাক্রমে নর্থ জোন ও ইস্ট জোনের বিপক্ষে দুইদিনের দুটি ম্যাচ খেলেন তাঁরা। আর বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচের পর যশোরে সাউথ জোনের বিপক্ষে দুইদিনের ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ সফর শেষ করে মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব।
১৯৭৭ সালের ৭ জানুয়ারি আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এমসিসির বিপক্ষে তিন দিনের ম্যাচটি খেলতে মাঠে নামে ‘বাংলাদেশ’ নাম নিয়ে। টস করতে আসেন বাংলাদেশের অধিনায়ক শামীম কবির ও এমসিসির অধিনায়ক টেড ক্লার্ক। টসের আগে শামীম কবির অবশ্য মনোস্থির করে নিয়েছিলেন যে টসে জিতলে আগে ব্যাটিং নিবেন। যেই ভাবনা সেই কাজ। শামীম কবির জিতলেন টসে এবং আগে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ৯ টা ৪৫ মিনিটে ম্যাচ পরিচালনার জন্য মাঠে নামেন দুই আম্পায়ার রেজা-ই-করিম ও আলতাফ হোসেন।
বাংলাদেশের হয়ে ইনিংসের গোড়াপত্তন করেন অধিনায়ক শামীম কবির ও সহ-অধিনায়ক রকিবুল হাসান। শুরু হয় বাইশ গজের খেলাটিতে বাংলাদেশের পথচলা। শামীম কবির ও রকিবুল হাসান দেখেশুনে খুব সাবধানতার সাথে ইনিংস শুরু করেন। তাঁরা যখন ধীরে ধীরে জুটি গড়তে থাকেন ঠিক তখনই আঘাত হানে এমসিসি। পেসার মার্টিন ভারননের বলে আউট হয়ে সাজঘরে ফিরে যান রকিবুল হাসান।
তার পর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট খোয়াতে থাকে বাংলাদেশ। এক পর্যায়ে স্কোরবোর্ডে ১৪৫ রান যোগ করতে তাঁরা হারিয়ে বসেন ৬ উইকেট। তবে ব্যাটিং ধসের ধাক্কাটা সেদিন সামলে ওঠেছিলেন অলরাউন্ডার ইউসুফ বাবু। দলকে একটি ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তুলে নেন তিনি নিজের কাঁধে। পুরো ইনিংসজুড়েই তিনি চড়াও হয়ে খেলেছিলেন এমসিসির বোলারদের ওপর। প্রথম দিন শেষে ইউসুফ বাবু অপরাজিত থাকেন ৬০ রানে। পরে দ্বিতীয় দিনের শুরুতে ব্যাট করতে নেমে ৭৮ রানে আউট হয়ে যান তিনি।
ইউসুফ বাবু দলের বিপর্যয়ের সময় দৌলতুজ্জামান ও এস এম ফারুকের সাথে পৃথক দুটি জুটি গড়েন যা পরবর্তীতে বাংলাদেশকে একটি ভালো সংগ্রহ পেতে সাহায্য করে। ৯ উইকেট হারিয়ে ২৬৬ রান করে প্রথম ইনিংস ঘোষণা করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের হয়ে শামীম কবির ৩০, এস এম ফারুক ৩৫ ও ওমর খালেদ রুমি করেন ২৮ রান। এমসিসির ড্যান পিয়াচউড ৩৮ রানে তুলে নেন ৩ উইকেট।
বাংলাদেশের ২৬৬ রানের বিপরীতে প্রথম ইনিংসে ব্যাট করে ৮১ রানের লিড পায় এমসিসি। মাইকেল মেন্সের হার না মানা ৭৫, মিক নরম্যানের ৭৪ ও জন বারক্লের ৬৫ রানের সুবাদে সবগুলো উইকেট হারিয়ে এমসিসির সংগ্রহ দাঁড়ায় ৩৪৭ রান। ব্যাটিংয়ের পর বল হাতেও বাংলাদেশের উজ্জ্বল পারফর্মার ইউসুফ বাবু। মাত্র ৩৭ রানে ৪ উইকেট তুলে এমসিসির রানের লাগাম টেনে ধরতে সাহায্য করেন তিনি। তাছাড়া দৌলতুজ্জামান নেন ৬৭ রানে ৩ উইকেট।
তার পর ৮১ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে শামীম কবিরের ২৫ ও ওমর খালেদ রুমির ৩২ রানের ওপর ভর করে ৬ উইকেট হারিয়ে ১৫২ রান সংগ্রহ করে বাংলাদেশ। সেইসাথে নিজেদের খেলা প্রথম ম্যাচটি ড্র করতে সক্ষম হন তাঁরা।
সেদিনের পর পার হয়ে গেল ৪৪টি বসন্ত। বিশ্ব ক্রিকেটে বর্তমানে বাংলাদেশ যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার ভিতটা মূলত তৈরি করে দিয়েছিল ১৯৭৭ সালে এমসিসির বিপক্ষে খেলা সেই ম্যাচটি। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এই ম্যাচটির মাহাত্ম্য অনেক। এই ম্যাচের মাধ্যমেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যতের বীজ বপন হয়েছিল। কারণ এই ম্যাচটিই পরবর্তীতে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কনফারেন্সের (বর্তমান ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল) সহযোগী সদস্যপদ পেতে সাহায্য করেছিল বাংলাদেশকে।
এমসিসিকে বাংলাদেশে এসে খেলার জন্য সর্বপ্রথম প্রস্তাব পাঠানো হয় ১৯৭৬ সালের মে মাসে। একই বছরের জুনে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কনফারেন্স বাংলাদেশকে সহযোগী সদস্য বানানোর ব্যাপারে আলোচনা করে এবং এমসিসির বিপক্ষে ম্যাচের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার পর ওই ম্যাচের পারফরম্যান্স দেখে এবং এমসিসির প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ১৯৭৭ সালের ২৬ জুন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কনফারেন্স বাংলাদেশকে তাঁদের সহযোগী সদস্য হিসেবে ঘোষণা করে। সেদিনের সেই ম্যাচটাই বাংলাদেশের জন্য খুলে দেয় আইসিসির দরজা। ফলে, আজকের দিনে বাংলাদেশের যে অবস্থান তার জন্য অবশ্যেই মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) ঋণ কখনোই শোধ হবে না।
- এমসিসির বিপক্ষে বাংলাদেশের একাদশ
শামীম কবির (অধিনায়ক), রকিবুল হাসান (সহ-অধিনায়ক), ওমর খালেদ রুমি, সৈয়দ আশরাফুল হক, মাইনুল হক, এস এম ফারুক, শফিকুল হক হীরা, ইউসুফ রহমান বাবু, দৌলতুজ্জামান, দিপু রায় চৌধুরী ও খন্দকার নজরুল কাদের লিন্টু।