সন্দীপ ‘ইমপ্যাক্টফুল’ পাতিল

গত শতাব্দীর আটের দশকে শ্রীকান্ত ও কপিল তাদের আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের জন্যে বিখ্যাত ছিলেন – এটা মোটামুটি সবাই জানে। তবে অনেকেই ভুলে যান, এই দুজনের সঙ্গে আরও একজন ক্রিকেটারকে। সম্ভবত তিনি নিজের ক্রিকেটকে ততটা সিরিয়াসলি নেন নি বলেই তাকেও অনেকে সিরিয়াসলি নেন না।

সন্দীপ পাতিল যদি নিজের ব্যাটিঙকে একটু সিরিয়াসলি নিতেন তাহলে কোথায় পৌঁছতে পারতেন তা নিয়ে পুরনো দিনের মানুষদের মধ্যে এখনও মাঝে মধ্যে আলোচনা হয়। প্রতিভায় যে তিনি কারও চেয়ে পেছিয়ে ছিলেন না তার প্রমান দুটি অসাধারণ ইনিংস- অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে লিলি – প্যাসকো– হগদের ঠেঙিয়ে ১৭৪ এবং তারপর ইংল্যান্ডে উইলিস – বোথামদের ছিন্নভিন্ন করে ১২৯। তার কয়েকটি ইনিংস এখনও ইউ টিউবে দেখতে পাবেন। চোখ ধাঁধানো ড্রাইভ, হাঁটু গেড়ে বসে স্পিনারদের পুল – স্যুইপ এবং সব মিলিয়ে অসাধারণ টাইমিং ও ক্লিন হিটিং ছিল তার ব্যাটিঙের বৈশিষ্ট।

পাতিল বাদ পড়েন কপিলেরই সঙ্গে, একই অভিযোগে – দিল্লি টেস্টে দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিং। অথচ কপিলের বেলায় যতটা হৈ চৈ হয়েছিল, তার শিকিভাগ পাতিলের বেলায় হয় নি। এবং তার শেষ চারটি টেস্ট ইনিংসের রান সংখ্যা ১২৭, ২০, ৩০ এবং ৪১। অবশ্য হৈ চৈ না হওয়ার একটা কারণ পাতিলের জায়গায় যে ব্যাটসম্যান দলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন তার অভাবনীয় সাফল্য। তিনি মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন।

তবে কথা হচ্ছে ১৯৮৩ বিশ্বকাপ নিয়ে। তা এই বিশ্বকাপ জয়েও সন্দীপ পাতিলের কিছু অবদান ছিল বইকি। যেমন ধরুন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচ। যশপালের ৮৯ এর ঠিক পরেই পাতিলের ৩৬ ভারতের হয়ে সর্বাধিক স্কোর। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে নক আউট, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেমি ফাইনাল এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ফাইনাল ম্যাচে। সবগুলিতেই সন্দীপ পাতিলের স্কোর দলের সেকেন্ড হাইয়েস্ট। এবং জিম্বাবওয়ের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে তার করা হাফ সেঞ্চুরি সেই ম্যাচের হাইয়েস্ট স্কোর।

তবে সব মিলিয়ে একদিনের ক্রিকেটেও খুব একটা উজ্জ্বল রেকর্ড নেই তার। হাজারখানেক রান করেছেন বটে, কিন্তু গড় ২৫এরও কম। তবে চোখে পড়ার মতো বস্তুটি হচ্ছে তার স্ট্রাইক রেট – ৮০র ওপর। যে যুগে শ্রীকান্তর ৭২ স্ট্রাইক রেট দেখে আমাদের চোখ বড়বড় হয়ে যেত।

সন্দীপের একদিনের ম্যাচের ক্যারিয়রের শুরুটা কিন্তু বেশ ধমাকেদার হয়েছিল – মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে, তার চেয়েও বড় কথা, লিলি, প্যাসকো, লসনদের বিরুদ্ধে ৭০ বলে ৬৪। ভারত সেই ম্যাচ জিতে নেয়, ম্যান অফ দ্য ম্যাচ পাতিলই হন। এছাড়াও খান কয়েক মারকাটারি একদিনের ইনিংস খেলেছেন পাতিল।

১৯৮১ সালে উইলিস, বোথাম, আন্ডারউড, লিভার সমৃদ্ধ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৫৫ বলে ৬৪; ১৯৮২ সালে শ্রী লঙ্কার বিরুদ্ধে ৪৮ বলে ৬৪; সেবছরেই ইমরানের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৬০ বলে ৮৪ এবং ১৯৮৩ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২৮ বলে ৫১। এছাড়াও ১৯৮৩ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তার ৩২ বলে ৫১ ছিল। শুধু রানের সংখ্যা নয়, রানগুলি যে রীতিমত রংবাজির সঙ্গে পাতিল করতেন সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না।

অরণ্যের প্রাচিন প্রবাদ, যে তলোয়ারের সাহায্যে জীবন ধারণ করে, তার মৃত্যুও সেই তলোয়ারের আঘাতেই হয়। পাতিলের ক্ষেত্রে এই মৃত্যু খুবই তাড়াতাড়ি ঘটেছিল। ক্রিকেট ছেড়ে ফিল্মের দিকে ঝুকেছিলেন কিছুদিন। এতে দুটো ক্ষতি হয়েছিল। এক, তার ফোকাস নিঃসন্দেহে ক্রিকেট থেকে কিছুদিনের জন্যে দূরে সরে গেছিল। এবং দুই, আমাদের ক্রিকেট কর্তাদের মনে তার ক্রিকেটের প্রতি সিরিয়াসনেস নিয়ে সন্দেহ জেগেছিল।

তবে সত্যি কথা বলতে সন্দীপ পাতিল আরও কিছুদিন দলে থাকলে আমাদের মতো ছেলে ছোকরারা অন্তত শ্রীকান্ত আউট হলেই কখন কপিল নামবে সেই আশায় বাকি ব্যাটসম্যানদের আউট করার জন্যে দেবদেবীর কাছে প্রার্থনা আরম্ভ করত না। দেখবেন, এর জন্যে তাদের আবার দেশদ্রোহী দাগিয়ে দেবেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link