কলকাতা কত দূর বাবা? শহরের মাঝ দিয়ে কি ট্রেন চলে? আমাদের গ্রামের চেয়ে বড় জায়গা কলকাতা?
‘আগে তো ওঠ’। বরিশাল জেলা থেকে ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে আসা বাবা বিরক্ত হয়ে ধমক দিলেন ছেলেকে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার তখনও বেশ কয়েক বছর বাকি।
স্বাধীনতার পর পনের বছর কেটে গেছে। ভারতের এক নম্বর বক্সার, ছাপ্পান্ন থেকে একষট্টি অপরাজিত জাতীয় চ্যাম্পিয়ন এক বাঙালি। নির্বাচিত হবার পরও যাওয়া হয়নি অলিম্পিকে। বক্সিং দলকে ছাড়পত্র না দেওয়ায়।
অশোক গাঙ্গুলি।
আন্ত: স্কুল প্রতিযোগিতা থেকে শুরু। নীলমণি দাস, জগাদার রিং হয়ে যোগ দিলেন ন্যাশনাল জিমন্যাসিয়ামে।
ন্যাশনালের কর্তা নির্মল মুখার্জি হীরে চিনতে ভুল করেননি। তখন ট্রেনার ছিলেন বাবু লাল, যিনি সেই সময়ে লাইটওয়েটে ভারতশ্রেষ্ঠ।
অশোককে দেখে বললেন এ ছেলে জাতীয় স্তরে সেরা হবে ছয় মাস সময় দিলে।
শুরু হল ট্রেনিং। বাবার সায় ছিল না। নাক ফাটিয়ে বাড়ি ঢুকলে কপালে জুটত আরও বেশি মার।
সাল ১৯৫৪, কলকাতা তখন বক্সিং জ্বরে আক্রান্ত। হরি সিং আসছেন। কে হরি সিং? যার নাম শুনলে অ্যাংলোরা ভয়ে পালিয়ে যায়। তিনি আসছেন এক অ্যাংলোর সাথে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে। তাও জায়গাটি আবার আমার বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিট দূরে। বৌবাজার ওয়াইএমসিএ-তে। ভাবা যায়! এখন অবশ্য সেই জৌলুস নেই।
প্রদর্শনী লড়াই চলছে। দুর্ভাগ্য এমনই,অ্যাংলো বক্সার মেডিকেল টেস্টে পাস করতে পারলেন না। হরি সিং কে দেখে তাঁর আতঙ্ক হয়েছিল হয়ত।
ছোটাছুটি শুরু সবার। এবার কি হবে? অশোকও ভাবছিলেন সত্যিই তো হরি সিং একেবারে না লড়ে ফিরে যাবেন?
হঠাৎই তাকে ডেকে পাঠালেন কালুবাবু। বললেন, ‘প্রদর্শনী লড়াইটা তোকেই লড়তে হবে। কয়েকটা ঘুষি খাবি, তারপর সারেন্ডার করে দিবি। ‘
রিং এ ওঠার আগে অশোকের শেষ কথা ছিল একবার বাথরুম যাব। রিং এ ওঠার সাথে সাথে হাসির ঢেউ উঠল। খানিকক্ষণ পরেই জোর আঘাত লাগল ডান চোখে। মাথা ঘুরে গেল মূহুর্তে।
রিং এর পাশ থেকে সবাই চিৎকার করে বলছে, সারেন্ডার কর খোকন।
রাউন্ডের পর কর্নারে দাঁড়াতেই কালুদা বললেন, ‘তোর চোখ দিয়ে রক্ত ঝরছে তো। বাঙালির মান টা রাখ। সারেন্ডার করতে হবে না।’
তখনও অশোক গাঙ্গুলি বাংলার জুনিয়র চ্যাম্পিয়নও নন।
পরের রাউন্ডের শেষে দেখা গেল হরি সিং নকআউট,নাক ফেটে রক্ত পড়ছে। রুমে ফিরে হাতটাও মেলাননি হরি সিং। বলেছিলেন পরের বার দেখে নেবেন। যদিও পরের বার আর আসেনি।
অলিম্পিকে সুযোগ না পেয়ে ইংল্যান্ডেও গেছিলেন হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন অশোক গাঙ্গুলি। অনুশীলন করতেন টেরি ডাউন্সের সাথে, যিনি বিশ্বজয়ী হয়েছিলেন সুগার রে রবিনসন কে হারিয়ে।
পেশাদার বক্সার হননি অশোকবাবু অলিম্পিকের পদকের আশায় থেকে। অথচ বঙ্গসন্তানের শেষ জীবনটা কেটেছে বেশ অর্থকষ্টে। রাজনীতি, বঞ্চনার শিকার তিনিও।
জায়ান্ট বেঙ্গলির গল্পের শেষ টা আরেকটু ভালো হতেই পারত। তবে তাতে ওনার কিছু যায় আসবে না।
আমরা টাইসন, হোলিফিল্ড, ফ্রেজিয়ার, মোহাম্মদ আলীর গৌরবগাথার কথা পড়ি তো বটেই,কিন্তু আমাদের নিজেদের ঘরের হেভিওয়েটের গল্প জানলে এটুকু তো নিজেদের বিশ্বাস করানোই যায়,যে বাঙালি যে কোন প্রতিকূলতাকে নকআউট করার ক্ষমতা রাখে। তা সে জীবনযুদ্ধে হোক, কি রিং এর মধ্যে।