আলোচনার সূত্রপাত হয় তাঁকে নিয়ে, আলোচনার শেষ দৃশ্যপটের মঞ্চায়নেও যেন তিনি থেকে যান কেন্দ্রীয় চরিত্রে। তবে এই শুরু আর শেষের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। শুরুতে যিনি মানুষের মনে সমালোচনার ক্রোধে জন্ম নেন , সেই তিনিই শেষটাতে সিক্ত হন ভালোবাসায়, মুগ্ধতায়। ম্যাজিক্যাল সাকিবের ধরনটাই যেন এমন। সকল আলোচনা, সমালোচনার পাশ কাটিয়ে তিনি হয়ে ওঠে অনন্য। রহস্যময় সেই সাকিবের চিত্রায়ণ যেন হলো ২০২৩ বিশ্বকাপেও।
এক বিশ্বকাপ আগে ফিরে যাওয়া যাক। ইংল্যান্ডে হওয়া সে বিশ্বকাপ নিয়ে বাংলাদেশ তখন প্রত্যাশার অসীম সীমানায় চোখ রেখেছে। কিন্তু সকলের কাছে যে ভাবনাটা স্বপ্নের রাজ্যেই বন্দী থাকে, সেটাই যেন বাস্তবে পরিণত করার দিকে চোখ রাখেন সাকিব। এ দুই পক্ষের ভাবনার দূরত্ব অনেক, ধরনটাও আলাদা। তবে সাকিবকে নিয়ে সমালোচনার সূত্রপাত হলো, বিশ্বকাপ দলের অফিশিয়াল ফটোসেশনে উপস্থিত না থাকা নিয়ে।
একটা ফটোসেশনই মাত্র। তাতে অনুপস্থিত থাকা নিয়ে যৌক্তিক সমালোচনা হবেই। তবে দেশের মানুষ থেকে আলোচক, বিশ্লেষক, সবাই যেন ব্যস্ত হয়ে উঠলো সাকিবের মুণ্ডুপাতে। সাকিবের অবশ্য এমন জাগতিক আলোচনায় আগ্রহও নেই, সমালোচনায় নুয়ে পড়ার মতো দুর্বলচিত্ত মানসিকতাও নেই। তাঁর চোখ জুড়ে তখন ১৯ বিশ্বকাপ রাঙানোর দিকে।
সাকিব যে ভাবনায় এগিয়ে ছিলেন, তার পুরোটা সেবার হয়নি। বাংলাদেশ ৮ম হয়ে শেষ করেছিল সেবারের বিশ্বকাপ। তবে সাকিব নিজে যা করে দেখিয়েছিলেন, তাতে তাঁর ঠাই হয়ে গিয়েছিল কিংবদন্তিতুল্য আসনে। ৬০৬ রানের সাথে ১১ উইকেট। ক্রিকেট ইতিহাসে বিশ্বকাপের মঞ্চে ততদিনে ৫০০ রান ও ১০ উইকেটের কীর্তিও কারো নামে যুক্ত হয়নি।
সাকিবের হাত ধরে সেই কীর্তি লেখা হলো বিশ্ব ক্রিকেট। কীর্তি গড়ায় সাকিব সেবার নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে গেলেন, তাতে ১৯ বিশ্বকাপটাই হয়ে গেল তাঁর বিশ্বকাপ। তবে সাকিব বোধহয় এখনও আক্ষেপ করেন, নিজের সেরা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিদায়টা আর সেরাদের কাতারে থেকে হয়নি। তবে ঐ যে সমালোচনা তীক্ষ্ণ তির যার দিকে শুরুতে ধেয়ে এসেছিল, সেই সাকিবই পারফরম্যান্স গুণে সেবার সবার হৃদয়ের মণিকোঠায় জায়গা নিলেন।
অবশ্য এরপরেও সমালোচনা পিছু নিয়েছে বারবার। আলোচনা, সমালোচনার সাথে তাঁর বাস চেন চিরন্তন। এই যেমন ২০২৩ বিশ্বকাপের আগেই তামিমের সাথে নিজের বৈরি সম্পর্কের ইস্যুতে বোমা ফাটালেন সাকিব। আর এরপর থেকেই আমজনতার কাছে সাকিব হয়ে উঠলেন জাতীয় ভিলেন। বিশ্ব ক্রিকেটে দুই সতীর্থের মধ্যে এটাই যেন প্রথম ঘটনা। আর সব দায়টা যেন সাকিবের একার।
চলমান সেই আলোচনায় সাকিবের যথারীতি প্রত্যুত্তর ছিল না। এমনকি বিশ্বকাপ শুরুর আগে গোড়ালিতে যখন ব্যথা পেলেন, তখন একটা পক্ষ মেতে উঠেছিল অদ্ভুত জয়োল্লাসে। সাকিবের ভ্রুক্ষেপ তাতেও ছিল না। কারণ তাঁর সব দৃষ্টি যে মূল মঞ্চে। সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্বকাপের মঞ্চে অনুমিতভাবেই নজর কাড়লেন সাকিব।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের শুরুতে যখন পেসাররা কিছুটা মলিন, তখন দলের উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনতে বল হাতে তুলে নেন সাকিব। ব্যাস। বাংলাদেশ শিবিরে প্রাণ সঞ্চার যোগ হয়েছে তখন থেকেই। তাঁর স্পিন বিষে নীল হয়ে ফিরে যান ইব্রাহিম, রহমান শাহ আর নাজিবুল্লাহ জদরান। সাকিবের বলে বাংলাদেশের ম্যাচে ফেরা, এরপর আধিপত্য বিস্তারের শুরু তখন থেকেই। সাকিবের নেতৃত্বে সেই দশার আর বদল হয়নি। বাংলাদেশ দল জয় নিয়ে ফেরে কোনো রকমের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন না হয়েই। কারণ মূল চ্যালেঞ্জটা যে নিয়েছিলেন সাকিবই।
বিশ্বকাপের মঞ্চে সাকিবের শেষের শুরু এটাই। বাংলাদেশ ক্রিকেটে বছরের পর রাজসিক পারফর্ম্যান্সে যিনি নিজেকে রাঙিয়েছেন, এবার তিনি ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে নিশ্চিতভাবেই রাঙাতে চান গোটা দলটাকেও। এ জন্যই তো বারবার তাঁর কন্ঠ জানান দিয়েছে, এই বিশ্বকাপে ভিন্ন কিছু করবে বাংলাদেশ। সাকিবের নেতৃত্বে সেই ‘ভিন্ন’ কিছুর উপলক্ষ্য হোক রাজসিক কিংবা শ্রেষ্ঠত্বে ঘেরা। বিশ্বকাপে তো আর বারবার সাকিবের ছোঁয়া পাবে না বাংলাদেশ। এই সম্ভাব্য বাস্তবতাই হোক বাংলাদেশ দলের দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলার পাথেয়।