১৯৮৬ সালের আগস্ট। নিউজিল্যান্ড দলের ইংল্যান্ড সফর। ওভাল টেস্ট। মারিজুয়ানা সেবনের অপরাধে নিষেধাজ্ঞার খড়গ নেমেছিল ইয়ান বোথামের ওপর। সেই টেস্টেই ফিরলেন, তিন উইকেট পেলেন। পড়ে ঝড়ো একটা হাফ সেঞ্চুরি করলেন।
সেই ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের ওপনার ব্রুস এডগার ক্যাচ তুলে দিলেন গ্রাহাম গুচের বলে, বোলার ছিলেন বোথাম। ফেরার সময় বোথামকে বলছিলেন, ‘তোমার চিত্রনাট্য কে লিখে দিয়েছে?’
সাকিব আল হাসানের বলে যখন মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে একের পর এক ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যান সাজঘরে ফিরছিলেন – তখন কেউ অবশ্য তাঁর চিত্রনাট্যকারের নাম জানতে চাইলেন না। কিন্তু, কেউ জিজ্ঞেস করে বসলে অবাক হওয়ার কিছু থাকতো না!
সাকিবের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার এই পারফরম্যান্সটা অবশ্য বোথামের প্রত্যাবর্তনকে আক্ষরিক অর্থেই ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি মাত্র আট রান দিয়ে নিয়েছেন চার উইকেট। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর সেরা বোলিং ফিগার ২৯ রানে পাঁচ উইকেট, গেল বিশ্বকাপের আফগানিস্তানের বিপক্ষে। এবার সেই পারফরম্যান্সকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। বোলিং কোটা পূরণ করতে পারলে হয়তো হয়েই যেত!
নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে গত অক্টোবরের শেষেই। কিন্তু, শ্রীলঙ্কা সফরটা কোয়ারেন্টাইন ইস্যুতে বাতিল হয়ে যায়। সাকিবের ফেরার প্রহরটা লম্বা হয়। যদিও, সাকিব দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে খেলেছেন।
যদিও, ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক টি-টোয়েন্টি এই টুর্নামেন্টে খুব সফল ছিলেন না সাকিব। গোটা টুর্নামেন্টে তিনি নয় ম্যাচ খেলেছেন। তাতে ১২০ স্ট্রাইক রেটে করেন ১১০ রান। এর মধ্যে ২৮ রানই এসেছে শেষ ম্যাচে। আর বোলিংয়ে নেন ছয়টি উইকেট। শ্বশুরের অসুস্থতার কারণে ফাইনাল না খেলেই ফিরে যান যুক্তরাষ্ট্রে।
তাই, সাকিব আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে কতটা নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন – সেটা নিয়ে একটা চাপা সংশয় ছিল, সেটা প্রতিপক্ষ তৃতীয় সারির ওয়েস্ট ইন্ডিজ হওয়ার পরও।
সাকিব অবশ্য মাঠে নামার সাথে সাথেই সকল সংশয় উড়িয়ে দিলেন এক ঝটকায়। মিরপুরে দিনের চতুর্থ ওভারের খেলা শুরু হওয়ার পরই নামে বৃষ্টি। এরপর যখন ম্যাচ আবার মাঠে গড়ায় তখন নামে ঝড়।
না, এই ঝড় প্রাকৃতিক কিছু নয়। এটা মানব সৃষ্ট ঝড়। ঝড়ের নাম – সাকিব আল হাসান। প্রিয় মঞ্চ মিরপুরে তার রুদ্রমুর্তিতে পুড়ে তরুণ ক্যারিবিয়ান দল। আন্দ্রে ম্যাককার্থিকে বোল্ড করে শুরু করলেন। এরপর অধিনায়ক জেসন মোহাম্মদকে স্ট্যাম্পিংয়ের শিকার করলেন, এরপর এনক্রুমাহ বোনারকে ফেললেন এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে। শেষটায় এসে বোল্ড করলেন আলজারি জোসেফকে।
সাকিব ক্ষুধার্ত ছিলেন উইকেটের জন্য। ইনিংস বিরতিতে বলেন, ‘ভাল লাগছে, ১৫ ১৬ মাস পর ফিরে পারফরম করা সহজ নয়। নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। শুধু আমি না, সবাই খেলতে খুব মরিয়া ছিল। কারণ, ১০ মাস পর সবাই মাঠে নেমেছে।’
ফিরেই মিতব্যয়ী বোলিং, সাথে চার উইকেট – রহস্যটা কি? – ‘আমি সিম্পল থাকতে চেয়েছি। শুধু জায়গায় মত বল ফেলতে চেয়েছি। লাইন ঠিক রেখেছি। বাকি কাজটা উইকেট করেছে।’
সাকিবের মত বাংলাদেশের গোটা বোলিং ইউনিটই ছিল ছন্দে। মুস্তাফিজুর রহমান শুরুতে আঘাত হানেন। প্রথম দুই উইকেট যায় তাঁর দখলে। এরপরের বাকিটা সময় সাকিব আর অভিষিক্ত হাসান মাহমুদের ভেলায় ভাসে বাংলাদেশের আশা। সাকিব দ্রুত তিনটা উইকেট পেয়ে পাঁচ উইকেট, এমনকি নিজের ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং ফিগারের দেখা পাওয়ারও স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তিনি।
তাকে বোলিং আক্রমণ থেকে সরানোর পরই উইকেটে থিতু হয়ে যান কাইল মেয়ার্স ও রভম্যান পাওয়েল। ষষ্ঠ উইকেটে দু’জন মিলে যোগ করেন ৫৯ রান। এরপর হাসান মাহমুদ জুটি ভাঙেন, দ্রুত তিনটা উইকেট পেয়ে তাঁর ওপর রাখা টিম ম্যানেজমেন্টের ভরসার প্রতিদান দেন।
আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসের লেজটা ছেটে ফেলেন সাকিব আল হাসান। ৭.২ ওভার বোলিং করে দুই মেইডেন, মাত্র আট রান দিয়েছেন। উইকেট নিয়েছেন চারটি। ‘কে সাকিবের চিত্রনাট্যকার’ সেই প্রশ্নে আমরাও না যাই, কারণ তাঁর চিত্রনাট্যকার তো তিনি নিজেই!