গর্ব সব টুটিয়া, মুর্ছি পড়ে লুটিয়া

হলুদ জার্সির ওপর কালো তারাগুলো নিয়ে যখন রিকি পন্টিং মাঠে নামতেন আমার অসম্ভব রাগ হতো। তখন শচীন-সৌরভ-দ্রাবিড়ের টিম ইন্ডিয়ার অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল অস্ট্রেলিয়াকে হারানো। কিন্তু হেইডেন-গিলক্রিস্ট ওপেনে নেমে সংহার শুরু করলেই সব আশা শেষ।

এমন কতবার যে আশাহত হয়েছি ওই বয়সে। কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছিলাম যোগ্য দলের কাছে হারার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই, রয়েছে নিজেকে যোগ্যতম করে তোলার শিক্ষা। সেদিন থেকে অস্ট্রেলয়ার প্রতি বিরূপ মনোভাব থাকলেও সেই ঘৃণার চাদরটা হঠাৎ করেই সরে গিয়েছিল।

২০০৫ সাল নাগাদ সাদারল্যান্ডশায়ারের মেনাই হাই স্কুলে স্টিভেন স্মিথ বসে আছেন কোচ ট্রেন্ট উডহিল-কে নিয়ে। প্রিন্সিপালের কাছে আর্জি ছিল স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবার যাতে বিকেলে ক্রিকেট প্র‍্যাকটিসের সময় কমে না যায়। উডহিল জানতেন পথটা কঠিন, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পড়াশোনা থেকে সরে গিয়ে ক্রিকেটে ঢুকে বহু বহু ছেলে প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ায়। কিন্তু উডহিল এটাও জানতেন যে স্মিথ একেবারে আলাদা, তাই দুজনের লড়াইটা শুরু হল ওই প্রিন্সিপালের রূম থেকেই।

অস্ট্রেলিয়ার সিডনি-মেলবোর্ণ অঞ্চলে শয়ে শয়ে ক্রিকেট ক্যাম্প হয় দু-বেলা, ব্যাগি গ্রিন সাম্রাজ্যের ব্যাটন তুলে দেবার জন্য যোগ্য ক্রিকেটার তৈরী করা অস্ট্রেলিয়ানদের অন্যতম জাতীয় কর্তব্য, কিন্তু স্মিথের ক্রিকেট পছন্দ হল না কারও।

কোচ উডহিল এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, ‘অস্ট্রেলিয়া কোনোদিন টেকনিক্যালি স্ট্রং না হলে কোনো খেলোয়াড়কে খেলোয়াড় বলেই মনে করে নাভ এখানে সবাই সত্তরের দশলের গ্রেগ চ্যাপেল হতে চায়, নব্বই-এর স্টিভ ওয়-হতে চায়, ২০০৩ এর রিকি পন্টিং হতে চায়, টেকনিক ছাড়া এখানে ক্রিকেটে সাফল্য কার্যত অসম্ভব ছিল স্মিথের জন্য।’

কিন্তু, উডহিল জানতেন স্মিথের ওপর গোঁড়া ক্রিকেট ব্যকরণ চাপিয়ে দিলে ওর নিজস্ব খেলাটা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই নিউ ওয়েলস একাডেমিতে শেন ওয়ার্নের ট্রেনিং-এ স্পিনার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করালেন স্মিথের। সবার অগোচরে চলতে লাগল ব্যাটিং অনুশীলন আর প্রকাশ্যে স্মিথ হতে থাকলেন অজি স্পিনার।

কিন্তু, গোকুলে বেড়ে ওঠা ব্যাটিংই অজি সাম্রাজ্যের ব্যাটন তুলে দিল স্মিথের হাতে। ডন ব্র‍্যাডম্যানের ক্রিকেট সাম্রাজে মাইকেল ক্লার্কের পর নতুন তারকা হয়ে উঠলেন স্মিথ। স্মিথের সাফল্য খুলে দিল অজি ক্রিকেটের একটা বন্ধ থাকা জানলা। স্মিথ যেন জক্ষপুরের বিশুপাগল হয়ে মনের আনন্দে খেলে চললেন সবুজ ঘাসে, হার্শা ভোগলে লিখেছিলেন, ‘স্মিথ ক্রিকেটার হতে চায় নি, স্মিথ ক্রিকেটের প্রেমিক হতে চেয়েছিল।’

সাংবাদিকদের সামনে কেঁদে ফেললেন স্মিথ, নিজের পাশে বসা ওয়ার্নারের কাঁধে হাত রেখে জোড় গলায় স্বীকার করে নিলেন বল টেম্পারিংয়ের ঘটনা। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসে সাইমন্ডস-গ্রেগ-পন্টিং রা যা পারেন নি অকপটে তাই করে দেখালেন তিনি।

ঠিক যে জায়গায় নিজের অর্থোডক্স ফুটওয়ার্ক না থেকেও ব্যাটের ফেসটা খুলে বল বাউন্ডারি পার কপ্রে দিতেন, যেভাবে ক্রমাগত অস্ট্রেলিয় স্লেজিং না করে চুপচাপ নিজের প্রতিভার স্ফুরণে প্রতিপক্ষকে চুপ করিয়ে দিতেন, যেভাবে টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাগি গ্রিণের বয়াটিং ব্যকরণকে চুরমার করে একেবারে নিজের স্বমহিমায় লাল বলটাকে সুইপ করে ঠেলে দিতেন ফাইন লেগের পাস থেকে সেভাবেই যেন সাংবাদিকদের সামনে বিশ্বের কাছে নিন্দিত অস্ট্রেলিয়ার মানসিকতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিলেন সেদিনের মেনাই হাই স্কুলের ছোট্ট ছেলেটা।

ডনের দেশে কিংবদন্তিরা ক্রিকেট প্রতিভার ডালি নিয়েই জন্মান। অতীতেও তাই হয়েছে ভবিষ্যতেও হবে। অজি সিংহাসনের গদি কখনো ফাঁকা থাকেনি। কিন্তু, স্মিথ যেন এক শিল্পীর মতো বসেছিলেন সেই গদিতে। শিল্পের কাছে সৎ থাকতে না পারার যন্ত্রণা যাকে কুড়েকুড়ে খেয়েছে এতদিন। ভাঙা তরী নিয়ে সমস্ত গর্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে এক শান্ত সন্ন্যাসীর মতো তিনি ফের বাইশ গজে ফিরে এসেছেন ক্রিকেটের টানে!

বল টেম্পারিংয়ে অন্যায়ে যেমন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় স্মিথকে আমরা মেনে নিয়েছি তেমনই ক্রিকেট রূপকথার এই নায়ককে আবার কাছে টেনে নেবেন ক্রিকেট ঈশ্বর। আবার ব্যাগি গ্রীণ ক্যাপ মাথায় শুরু হয়েছে নতুন রূপকথা, এখানেই তো জিতে গেছে ক্রিকেট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link