ক্রীড়াবিদদের প্রায়ই খেলা শুরুর আগে কানে হেডফোন দিয়ে গুণগুণ করতে দেখা যায়। টিম বাসে উঠানামা কিংবা দৌড়ানোর সময় গান শোনাটা একপ্রকার নিয়মিত ঘটনাই খেলোয়াড়দের জন্য। এছাড়া যেকোনো টুর্নামেন্টেই প্রতিটা দলের জন্য থাকে থিম সং। কারণটা হলো খেলোয়াড়দের চাপমুক্ত রাখা, উজ্জীবিত করা, তিনি যেন তার সেরাটা দিতে পারেন মাঠে।
পাকিস্তান কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী ওস্তাদ নুসরাত ফতেহ আলি খান। সুরের মূর্ছনায় পুরো বিশ্বকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলেন কয়েক দশকের বেশি সময়। ভাবছেন ক্রিকেট নিয়ে লেখায় ফতেহ আলি খান আসলেন কোথা থেকে। সম্পর্ক আছে, নুসরাত ফতেহ আলি খান এতটাই মোহমায়া ছড়াতেন তাঁর গানে, ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জেতার পেছনেও ছিল তার গানের অবদান। বুদ্ধিটা প্রথম এসেছিল অধিনায়ক ইমরান খানের মাথায়, যিনি কিনা কয়েকদিন আগেও ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।
তিনিই বিশ্বকাপের আগে পুরো দলকে নিয়ে দেখা করেন ফতেহ আলি খানের সাথে। এরপরই তার স্বর্গীয় সুরের ‘কাওয়ালি’ নিয়মিত হয়ে যায় পাকিস্থান ড্রেসিংরুমে। আমির সোহেলের ক্যাসেটের সুবাদে ড্রেসিংরুম, টিমবাস কিংবা ট্রেনিং এরিয়াতে সবসময়েই শোনা যেত ফতেহ আলী খানের গলায় ‘আল্লাহু আল্লাহু’ ধ্বনি।
তবে শুরুর দিকে পাকিস্তান ম্যাচ হারায় তোপের মুখে পড়েন ফতেহ আলি খানও। ভক্ত-সমর্থকরা দাবি করেন দলের হারের জন্য কাওয়ালি দায়ী। তাদের উগ্রতা দেখে ভয় পেয়ে তিনি ফোন করেন বন্ধু ইমরান খানকে। ইমরান আশ্বস্ত করেন বন্ধুকে এবং বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই কাওয়ালি শুনি, শুনবো এবং আমরা বিশ্বকাপ জিততে যাচ্ছি।’ বিশ্বকাপ জেতার ব্যাপারে এতটাই আত্নবিশ্বাসী ছিলেন পাকিস্থানি কাপ্তান। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেবার ঠিকই বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছিল পাকিস্থান।
বিশ্বকাপ জয়ের কয়েক বছর বাদে সংবাদমাধ্যমে সেই সময়ের কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কাওয়ালির কথা জানান ইমরান। তার ভাষ্যমতে সংগীত পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করতো। কাওয়ালি ছিল বিশেষ কিছু যেটা সবসময় খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত রাখতো। নুসরাত ফতেহ আলি খানের ভাষায় হার মানেই হেরে যাওয়া নয়, নতুন দিন শুরু হয় নিত্য-নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন নিয়ে। এটাকেই আপ্তবাক্য হিসেবে নিয়েছিলেন পাক ক্রিকেটাররা।
কেবল পাকিস্তানিরাই নয়, তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিখ্যাত ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকারও চাপ কাটাতে শরণাপন্ন হয়েছিলেন সংগীতের। সেবার অস্ট্রেলিয়া সফর মোটেও ভালো যাচ্ছিল না শচীনের, রান করেছিলেন যথাক্রমে ০,১,৩৭,০ এবং ৪৪। ক্যারিয়ারের প্রায় প্রতিটা সময় প্রতিপক্ষকে রানের পাহাড়ে চাপা দেয়া শচীন তাই মোটেই স্বচ্ছন্দে ছিলেন না। পাশাপাশি ভারতের শতকোটি ক্রিকেটভক্তের প্রত্যাশা মেটানোর চাপ তো ছিলই।
সিডনি টেস্টের আগে তাই শচীন শরণাপন্ন হয়েছিলেন বিখ্যাত কানাডিয়ান গায়ক ব্রায়ান অ্যাডামসের “সামার অফ ৬৯’ গানের। ম্যাচের পাঁচদিন আগে থেকে তিনি কেবল এই গানই শুনতেন নিজেকে অনুপ্রাণিত করার জন্য। আর সেই টেস্টেই শচীন খেলেন তার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস, অপরাজিত থাকেন ২৪১ রানে। কেবল তার ক্যারিয়ার নয়, পুরো ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ইনিংস সেটি। গিলেস্পি, লি, ম্যাকগিলদের সেদিন বড় অসহায় লাগছিলো শচীনের দাপটের সামনে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেই ম্যাচে শচীন একটাও কাভার ড্রাইভ খেলেননি!
কেবল খেলোয়াড়দেরই নয়, সংগীতশিল্পীরা যুগে যুগে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন কোচদেরও। আর্সেনালের সাবেক কোচ এবং বিখ্যাত ফুটবল দার্শনিক আর্সেন ওয়েঙ্গার অকপটে স্বীকার করে নেন তার জীবনে ‘দ্য বিটলস’ এর প্রভাবের কথা। জার্মান সীমান্তের সেই ছোট্ট ফরাসি গ্রাম থেকে ইংলিশ ফুটবলের শীর্ষ দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে তাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে বিটলসের গান।
বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে জানান তাঁর প্রিয় গানের কথা। ‘ইমাজিন আমার সবচেয়ে পছন্দের গান। বিটলসের গান আমাকে কঠিন জিনিস সহজ করে ভাবতে শেখায়।’ আর্সেনালও বোধহয় এই কারণেই কঠিন ফুটবলটা সহজ করেই খেলতো। তাঁর অধীনেই আর্সেনাল প্রিমিয়ার লিগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়।
নুসরাত ফতেহ আলি খান থেকে ব্রায়ান অ্যাডামস কিংবা দ্য বিটলস – পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থেকেও তারা অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন বিশ্বব্যাপী শতকোটি মানুষকে, একটু একটু এগোতে সাহায্য করছেন তাঁদের স্বপ্নের পথে।