উৎসবের মঞ্চে শোকের মাতম

কিংবদন্তীতুল্য এই ব্যাটসম্যান এতটাই শোকস্তব্ধ ছিলেন যে - বড় সময়ের জন্য চলে যান ক্রিকেটের বাইরে।  অনেকটা সময় বাদে যখন তিনি ফেরেন, তখন তাঁর মধ্যে প্রথম জীবনের সেই জৌলুশ ছিল না। ২০০৩ বিশ্বকাপে খেলেন ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ।

৩১ আগস্ট, ২০০১। পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক দিন। মুলতানে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে মুখোমুখি বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উত্তপ্ত গরমে সেদিন ম্যাচ দেখতে মুলতানে জড়ো হয় ১২ হাজার মানুষ। এই টেস্টের আগে দশ বছর মুলতানে কোনো টেস্টই হয়নি! স্টেডিয়াম সংস্কারের পর ছিল মুলতানের প্রথম টেস্ট। সব মিলিয়ে দর্শকদের মাঝেও তাই ছিল বাড়তি উত্তেজনা।

ওই ম্যাচেই পাকিস্তানের হয়ে অভিষিক্ত হন শোয়েব মালিক ও তৌফিক উমর। এছাড়া ঘরের মাঠ মুলতানে ইনজামাম উল হকের প্রথম ম্যাচ ছিল! অপরদিকে, দীর্ঘসময় বাজে ফর্মে থাকা দানিশ কানেরিয়ার জন্য ছিল বড় সুযোগ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট আর সেই টেস্টে জয় পেতে মরিয়া পাকিস্তান। পাকিস্তানের শক্তিশালী একাদশে সামনে বাংলাদেশের বেশ আনকোরা একটি দল! ম্যাচের আগেই অনুমেয় করা হচ্ছিল ওয়াসিম আকরাম-ওয়াকার ইউনুসদের সামনে দাঁড়াতে পারবে তো তাঁরা?

টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ অধিনায়ক নাইমুর রহমান দূর্জয়। ওপেনিংয়ে ২০ রানের জুটি গড়েন জাভেদ ওমর বেলিম ও মেহরাব হোসেন। দলীয় ২০ রানে ওয়াকার ইউনিসের বলে অভিষিক্ত শোয়েব মালিককে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন জাবেদ। একপ্রান্তে ওয়াসিম আকরাম বোলিংয়ে প্রভাব ফেলতে না পারলেও ওয়াকার ইউনুসের বলে ধুঁকছিল বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা।

দ্বিতীয় উইকেটে ৩০ রানের জুটির পথে হাবিবুল বাশার ফেরেন ব্যক্তিগত ১৩ রানে। ওয়াকার ইউনুস নিজের দ্বিতীয় শিকার করেন। এরপরে দুই দিকেই পেস আক্রমণ থামিয়ে দুই দানিশ কানেরিয়া ও শোয়েব মালিককে আনেন পাকিস্তান অধিনায়ক রশিদ লতিফ। দলীয় ৫৫ রানেই মেহরাব হোসেনকে নিজের প্রথম শিকার বানান কানেরিয়া। এরপর দলীয় ৬৭ রানে আমিনুল ইসলামকে বোল্ড করে মেইডেন উইকেট লাভ করেন মালিক।

৬৭ রানেই নেই দলের ৪ উইকেট! দানিশ কানেরিয়ার সামনে যেন দাড়াতেই পারছিলেন না বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানরা। এরপর কানেরিয়ার স্পিন ভেলকিতে নিয়মিত উইকেট হারাতে থাকে বাংলাদেশ। ৮৩ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে চরম বিপর্যয়ে পড়ে বাংলাদেশ দল। লোয়ার অর্ডারে হাসিবুল হোসেন শান্ত, মোহাম্মদ শরীফরা কিছুটা ভিত গড়ার চেষ্টা করলেও কানেরিয়ার ম্যাজিকে ১৩৮ রানেই গুড়িয়ে যার সফরকারীরা। কানেরিয়া ৪২ রানে ক্যারিয়ার সেরা ৬ উইকেট শিকার করেন! প্রথম দিনের এক সেশন পেরোতেই অলআউট বাংলাদেশ।

নিজেদের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে সাইদ আনোয়ার ও অভিষিক্ত তৌসিফ উমরের ব্যাটে ওপেনিং জুটিতেই বাংলাদেশের রান টপকে যায় পাকিস্তান! অভিষিক্ত উমর ফিফটি ও সাইদ আনোয়ার তুলে নেন সেঞ্চুরি। এই সেঞ্চুরির পথেই সাইদ আনোয়ার টেস্ট ক্রিকেটে ৪ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন।

দিনের ১৫ ওভার বাকি থাকতে দলীয় ১৬৮ রানে ব্যক্তিগত ১০১ রানে সাইদ আনোয়ারকে ফেরান পেসার মোহাম্মদ শরীফ। এরপর ফয়সাল ইকবালকে বোল্ড করে বাংলাদেশকে ম্যাচে ফেরানোর চেষ্টা করেন শরীফ। দিনের খেলা যখন শেষ; পাকিস্তান তখন ৪৪ রানে এগিয়ে!

৭৭ রানে অপরাজিত থেকে দ্বিতীয় দিন শুরু করেন তৌফিক উমর। সেই সাথে উইকেটে ছিলেন ৩১ বছর বয়সী ইনজামাম উল হক। পাকিস্তান ক্রিকেটে তখন তিনি বড় এক নাম। তৃতীয় উইকেটে উমরকে নিয়ে ৮০ রানের জুটি গড়েন ইনজামাম। এর মাঝে খালিদ আব্দুল্লাহ, জাভেদ মিঁয়াদাদ, সেলিম মালিক, মোহাম্মদ ওয়াসিম, আলী নাগভি, আজহার মাহমুদ এবং ইউনিস খানের পর অষ্টম পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিষেকে সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন তৌফিক উমর। ওই ইনিংসে টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবার দুই বাঁ-হাতি ওপেনারই সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন।

এরপর দলীয় ১০৪ রানে তৌফিক ব্যক্তিগত ১০৪ রানে ফিরলে ইনজামামের সাথে জুটি বাঁধেন মোহাম্মদ ইউসুফ। চতুর্থ উইকেটে দু’জনে মিলে যোগ করেন ১২৩ রান! এই জুটির পথে ইনজামাম তুলে নেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। দলীয় ৩৮১ রানে ব্যক্তিগত ১০৫ রানে রিটায়ার্ড হার্ট হন ইনজামাম।

চতুর্থ উইকেট ইউসুফের সঙ্গী হন আব্দুল রাজ্জাক। দু’জনের হার না মানা ১৬৫ রানের জুটিতে ৩ উইকেটে ৫৪৬ রানে ইনিংস ঘোষণা করে পাকিস্তান। মোহাম্মদ ইউসুফ অপরাজিত থাকেন ১০২ রানে। মজিদ খানের পর পাকিস্তানের হয়ে টেস্টে দ্বিতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরি করেন আব্দুল রাজ্জাক। একই সাথে টেস্ট ইতিহাসে দ্বিতীয়বার একই উইকেটে দুইটি ভিন্ন জুটির সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়ে পাকিস্তান।

চতুর্থ উইকেটে ইনজামাম ও ইউসুফের ১২৩ রানের পর ওই চতুর্থ উইকেটেই ইউসুফ ও আব্দুল রাজ্জাক ১৬৫ রানের জুটি গড়েন! এর আগে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কিংস্টনে ১৯৫৯-৬০ মৌসুমে প্রথম এই কীর্তি গড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেই সাথে টেস্ট ইতিহাসে দ্বিতীয়বার এক ইনিংসে পাঁচ সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়ে পাকিস্তান। এর আগে ১৯৫৫ সালে কিংস্টনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এই কীর্তি গড়ে অস্ট্রেলিয়া।

৪৫৫ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় দিনের শেষভাগে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামে বাংলাদেশ। আবারো ওয়াকার ইউনিসের তোপে শুরুতেই ২২ রানে ২ উইকেট হারায় সফরকারীরা। তৃতীয় উইকেটে ৩০ রানের জুটি গড়লেও দিনের একদম শেষ সময়ে দানিশ কানেরিয়ার বলে ফেরত যান আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ৩ উইকেটে ৫৫ রানে দ্বিতীয় দিন শেষ করে বাংলাদেশ।

৩৫৭ রানে পিছিয়ে থেকে তৃতীয় দিনে ব্যাটিংয়ে নামে বাংলাদেশ দল। বাংলাদেশের বড় পরাজয় তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসেও কানেরিয়ার ম্যাজিকে টপাটপ উইকেট হারাতে থাকে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানরা। একপ্রান্তে হাবিবুল বাশার মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেও আকরাম, নাইমুর রহমান, খালেদ মাসুদরা ছিলেন আসা যাওয়ার মিছিলে। ৯৬ রানেই ৭ উইকেট হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে বাংলাদেশ! কানেরিয়া শিকার করেন ফাইফর। অষ্টম উইকেটে হাবিবুল বাশার ও হাসিবুল শান্তর ৪৫ রানের জুটি বাংলাদেশের মান বাঁচায়। দলীয় ১৪১ রানে শান্ত ১৮ রানে ফিরলে ১৪৮ রানেই গুড়িয়ে যায় সফরকারীরা।

একপ্রান্তে ৫৬ রানে অপরাজিত থাকেন হাবিবুল বাশার। অপরদিকে, দ্বিতীয় ইনিংসেও ৬ উইকেট শিকার করেন দানিশ কানেরিয়া। এছাড়া ওয়াকার ইউনুস শিকার করেন ৪ উইকেট। দু’জনে মিলেই গুড়িয়ে দেন বাংলাদেশের ব্যাটিং শিবির। তৃতীয় দিনে এক সেশন না যেতেই শেষ বাংলাদেশের ইনিংস। এক ইনিংস ও ২৬৪ রানের বিশাল জয় পায় পাকিস্তান।

সেই সাথে ম্যাচ শেষে সাইদ আনোয়ার নিজের তিন বছর বয়সী মেয়ে বিসমাহ’র মৃত্যুর সংবাদ দেন সতীর্থদের! শোকে স্তব্ধ আনোয়ারের সাথে সাথে নিশ্চুপ পাকিস্তান দল। এতো বড় জয়েও নেই কোনো উল্লাস। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় জয়ের দিনে সাঈদ আনোয়ার যে হারিয়েছেন নিজের পরম আদরের রত্নকে!

কিংবদন্তীতুল্য এই ব্যাটসম্যান এতটাই শোকস্তব্ধ ছিলেন যে – বড় সময়ের জন্য চলে যান ক্রিকেটের বাইরে।  অনেকটা সময় বাদে যখন তিনি ফেরেন, তখন তাঁর মধ্যে প্রথম জীবনের সেই জৌলুশ ছিল না। ২০০৩ বিশ্বকাপে খেলেন ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link