ফুটবলে এক চিলতে আলোর রোশনাই

এমন প্রধান্য বিস্তার করে ম্যাচ ঠিক কবে জিতেছিল বাংলাদেশ! স্মৃতির গহীনে হাতরে খুঁজেও সম্ভবত পাওয়া যাবে না। ০-১ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়েও ৩-০ গোলে জয় মঞ্চস্থ তো বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসেও বিরল। মালদ্বীপকে সাফ চ্যাম্পিয়ন্সশিপে শেষ হারানো গিয়েছিল দুই দশক আগে। যেবার প্রথম আর শেষ সাফ জেতা হল।

এসব তো সবই জানা। কিন্তু এই উন্মাদ করে দেওয়ার মত ঘটনাটা হলো কি করে! এমন বিস্ময় জাগা অস্বাভাবিক নয়। দেশের ফুটবল যখন জরাজীর্ণ অবস্থায়, ঠিক এমন জয়গুলো তো নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। সেই স্বপ্নের পথে সারথি সতেরো না পেরনো শেখ মোরসালিন যেমন আছেন, তেমনি ফিনল্যান্ডের আয়েশি জীবন ছেড়ে রক্ষণের চৌকস সেনানী বনে যাওয়া তারিক কাজীও রয়েছেন।

তবে সম্মুখভাগে নিশ্চিতরুপেই রয়েছেন স্প্যানিশ কোচ হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরা। শুরুর দিকে হোঁচট খেয়েছেন। এই বাংলার ফুটবল খেলার সক্ষমতা বুঝতে খানিকটা ভুল করেছিলেন তিনি। সময় প্রয়োজন তো বটেই। ইউরোপের ফুটবলের সাথে তফাৎ তো নিদেনপক্ষে শত বছরের।

 

প্রাথমিক সেই ধাক্কা সামলে নিয়েছেন তিনি। খেলোয়াড়দের হন্যে হয়ে খুঁজেছেন ঘরোয়া লিগ জুড়ে। প্রায় প্রতিটা ভেন্যুতে ছুটে বেড়িয়ে নিজের পরিকল্পনার ছকে স্থান দিয়েছেন ঈসা ফয়সালদের। ইয়াসিন আরাফাতকে প্রাথমিক দল থেকে বাদ দেওয়ায় খানিকটা অবাকই হয়েছেন অনেকে।

ঈসা ফয়সাল নিজের কাজটা ঠিকঠাকই করে যাচ্ছেন বলতে হয়। ইউরোপিয়ান ফুটবলের ধাঁচে দুই ফুলব্যাক ব্যবহার করে বাংলাদেশ অন্তত কার্যকর অ্যাটাক সাজাতে এখনও সক্ষম নয়। সেদিক থেকে রক্ষণে ফুলব্যাকের বাড়তি নজরটা প্রয়োজন। সে কাজটা ঈসা করেছেন মালদ্বীপের বিপক্ষে। একটা হলুদ কার্ডও দেখেছেন। তবে সেটাও দলের সার্থেই।

অন্যপাশে থাকা বিশ্বনাথ ঘোষ, সম্ভবত বাংলাদেশ ফুটবলে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত ফুটবলারদের একজন। কারণ প্রচণ্ড পরিমাণে মিস পাস। সেই বিশ্বনাথ ঘোষ রীতিমত একটা মেশিন হয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। একেরবারেই ভুল পাস যে তিনি দেননি, তেমনটিও নয়। তবে তিনি গোটা ম্যাচ জুড়েই মালদ্বীপের খেলোয়াড়দের যতটুকু সম্ভব অস্বস্তিতে রেখেছেন।

শেষের দিকে মোরসালিনের করা গোলটায় তো তারই অবদান সবচেয়ে বেশি। মালদ্বীপের খেলোয়াড় পা থেকে বল ছিনিয়ে বেশ খানিকটা টেনে আলতো টোকায় পাস দিয়েছিলেন বিশ্বনাথ। এরপর তো রীতিমত মোরসালিন দেখিয়েছেন নিজের শীতল মানসিকতা। এই বয়সেই স্নায়ুচাপটা কি অবলীলায় নিয়ন্ত্রণ করলেন তিনি। যেখানে বাংলাদেশের ফুটবলাররা ডি-বক্সে ঢুকে দিশেহারা হয়ে যায়, সেখানে মোরসালিনের ক্লিনিক্যাল ফিনিশ।

একজন ডিফেন্ডারকে বোকা বানিয়ে বাঁ-পায়ের মাটি কামড়ানো শট। তিন পয়েন্ট নিশ্চিত। এদিন অবশ্য ম্যাচের মোর ঘুরিয়ে দেওয়ার অন্যতম কারিগর সম্ভবত রাকিব হোসেন। তপু বর্মণের হেডে বাড়িয়ে দেওয়ার বলটা তিনিই তো জালে জড়িয়ে প্রত্যাবর্তনের গল্পের শুরুটা করেন।

তবে অপরপ্রান্ত থেকে ফয়সাল আহমেদ ফাহিমের গতি ভয় ধরিয়েছে বারংবার। তার গতির ঝলক অবশ্য লেবাননের বিপক্ষে ম্যাচেও আলো কেড়েছিল। গোলকিপারের মাথার উপর দিয়ে বলটা চিপ করে দিতে পারলেই হয়ত সেদিনও হতে পারত অন্যরকম কোন এক ফলাফল।

তারিক কাজী যেন সর্বাজ্ঞে নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছেন। রক্ষণ সামলে আক্রমণেও দলকে এগিয়ে দিচ্ছেন। চোট নিয়ে মাঠ ছাড়ার আগ অবধি শতভাগের চাইতে একটু বেশিই যেন নিঙড়ে দিয়েছেন তারিক কাজী। বহুদিন বাদে বলের দখলটাও নিজেদের পায়ে রাখতে পেরেছে বাংলাদেশ। খানিকটা গুছিয়ে খেলার প্রয়াশ। সেখানে বাহবা পেতেই পারে গোটা দল।

ঘোর অন্ধকারের মাঝে এক চিলতে আলোর উৎস। হয়তবা চাইলেই আকাশ-কুসুম ভাবনায় বিভোর হওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবতা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনাল অবধি। তবে এর আগে প্রয়োজন ভুটান বাঁধা অতিক্রম করা। সমুদ্রের অথৈ জলরাশি সাতরে এবারে পর্বত চড়ার পালা। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই আরও একটি জয়ের নীল নকশাই করছে। তাতেই তো মিটবে তৃষ্ণা, ঘুচবে খরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link