অদ্ভুত এক উৎসর্গ

অনেকে বলেন, দেশ বলে কিচ্ছু নেই, কাঁটাতারের বেড়া ইত্যাদি সব মানুষের তৈরি। যা আছে তা সবই রাজনীতির জন্য, নিরস ‘geopolitical Slice’। অনেকে আবার বলেন, আবেগ বলেও কিচ্ছু হয় না, বিজ্ঞানে নেই। যা আছে তা হরমোন ক্ষরণ, ‘অ্যাড্রিনালিন রাশ’। তাঁদের কাছে দেশপ্রেম নিছক বানানো গল্প, প্রোপাগান্ডা।

তবে, সত্যিই কি তাই? স্রেফ একটা প্রোপাগাণ্ডার চক্করে নিজেকে উৎসর্গ করে দেয় লক্ষ লক্ষ লোক। এত্ত বোকা? আপাতদৃষ্টিতে পাগলই মনে হবে হয়ত। নাহলে কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ ভাইরাল ফিভার নিয়ে অজিদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় বলুন তো! ভদ্রলোক যখন ব্যাট করতে নামছিলেন, ততক্ষণে চার উইকেট পড়ে গিয়েছিল ভারতের। ম্যাকগ্রার বলে সৌরভ ফিরে যাওয়ায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল ইডেন গার্ডেন্স। একেই ফলো-অন, তার ওপরে আবার ব্যাটিং ধস! ভিডিওকন টিভির সামনে বসে থাকা ভারতীয়রা বোধহয় যে যার কাজে চলেও গিয়েছিলেন।

কিন্তু না, হার মানেননি, হাল ছাড়েননি পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির কর্নাটকী। ঘূর্ণি পিচে শেন ওয়ার্ন, ম্যাকগ্রা, গিলেসপিকে সামলে মাটি কামড়ে পড়েছিলেন বাইশ গজে। সঙ্গী ভিভিএস তখন যেন মহাকাব্য লিখছেন, একের পর এক ড্রাইভ, ফ্লিক ধাক্কা খাচ্ছে বাউন্ডারিতে। মার্চের প্যাচপ্যাচে গরমে যখন বিপক্ষের কাঁধ নেমে যাচ্ছে ক্লান্তিতে।

ঠিক তখনই খেলাটা ধরলেন তিনি। প্রতি আক্রমণ শুরু করলেন স্কোয়্যার কাট, ফ্লিক সমস্ত অস্ত্রে। স্কোরকার্ড বলছে, ৩৫৩ বল খেলেছেন তিনি, ব্রিটানিয়ার স্টিকার সাঁটা ব্যাট থেকে ঝলসে বেরিয়েছে ১৮০ রান। সেই ম্যাচে ২৮১ রানের মহাকাব্যের জন্য ইতিহাস অমরত্বের পুরস্কার দিয়েছে সঙ্গী ভিভিএসকে। কিন্তু আশ্চর্য, দ্রাবিড় বরাবরই নির্বিকার। সেই ইনিংসের বহু বছর বাদে জানা গিয়েছে, ভাইরাল ফিভার নিয়ে ব্যাট করেছিলেন সেইদিন।

সেই যে সেবার সাধারণ একটা টেস্ট ম্যাচকে অসাধারণ করে তুলেছিলেন ‘জাম্বো’। ভাঙা চোয়াল নিয়ে বল হাতে দাঁড়িয়েছিলেন রান-আপে। ঘাবড়ে গিয়েছিলেন ব্রায়ান চার্লস লারা। সেদিন বোধহয় কুম্বলের হার না মানা মনোভাবের কাছেই উইকেট দিয়ে এসেছিলেন রাজপুত্র৷

শুধু ভারত নয়, বিশ্বজুড়ে এরকম প্রচুর আছে। ভাঙা হাতে প্রোটিয়া অধিনায়ক গ্রেম স্মিথের ব্যাট করতে আসা, ১৯৯২ বিশ্বকাপ জুড়ে পেইন কিলার খেয়ে ইমরানের অধিনায়কত্ব, ক্যানসারকে পাত্তা না দিয়ে যুবরাজের বিশ্বকাপ জেতানো। এই ধরনের কিছু ঘটলে আপনা থেকেই শ্রদ্ধায় নত হতে ইচ্ছে করে। শত্রুপক্ষের সৈনিকের মৃত্যুর পর যেভাবে স্যালুট করে সেনা। ঠিক সেভাবেই অদ্ভুত এক সম্মান চলে আসে ওই ব্যক্তিটির প্রতি।

সেমিফাইনালে পাকিস্তান হেরেছে বলে দারুণ আনন্দ পেয়েছি। স্বাধীনতার পর থেকে যে দেশটা শ’য়ে শ’য়ে লাশ এবং ঘৃণা ছাড়া কিছুই উপহার দেয়নি আমাদের। তাদের প্রতি পালটা ঘৃণা ছাড়া কিচ্ছু আসে না আমার। আমি মনেপ্রাণে চাই প্রতিটা ক্ষেত্রে মুখ থুবড়ে পড়ুক ওই বর্বর দেশটা৷ যারা আমার দেশে বসে ওই দেশের জয়ে বাজি ফাটায়, তাদের একগাদা গালিগালাজ করতেও দু’বার ভাবি না আমি।

কিন্তু ওই যে বললাম, বিশ্বের যে প্রান্তেই হোক, দেশপ্রেমের নজির দেখলে আমি বরাবর গলে যাই। সেমিফাইনালের আগে দু’দিন ধরে হাসপাতালে ছিলেন মহম্মদ রিজওয়ান। কী নিয়ে? জানা গিয়েছে, ফুসফুস জনিত কোনও সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। তারপরেও কিনা ফিরলেন, বাইশ গজে ফিরে অজিদের বিরুদ্ধে ৬৭ রানের ইনিংস খেললেন। তিনি একটা দিক ধরে না থাকলে হয়ত মাঝের ওভারে পাকিস্তানের টুঁটি চেপে ধরতে পারত অজিরা। তবে রিজওয়ান তা হতে দেননি।

ফুসফুসের সমস্যা নিয়েও ব্যাট করেছেন। ২০ ওভার ফিল্ডিংয়ের সময় গোটা দল পরিচালনা করেছেন চঞ্চল স্বভাবে। হয়ত জানতেন, তিনি ছাড়া গতি নেই। বিকল্প উইকি সরফরাজ পাতে দেওয়ার যোগ্য নন। তাই হাসপাতালের বিছানা ছেড়ে হাজির হয়েছেন বাইশ গজে।

‘কৌন হ্যাঁয় ইয়ে লোগ, কাঁহা সে আতে হ্যাঁয় ইয়ে লোগ?’ কীভাবে পারেন এরা? শুধুই হরমোন ক্ষরণ? শুধুই একটা ভুখণ্ড? নাকি অদ্ভুত একটা উন্মাদনা ‘স্ব’ কে তুচ্ছ করতে শেখায়, উৎসর্গের কথা বলে দেয় কানে কানে। সেই পাগলামো বুঝি দেশ মানে না, জাত মানে না, মিলিয়ে দেয় দ্রাবিড়, কুম্বলে, যুবরাজ, রিজওয়ানকে৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link