মাত্রই সুপার কাপের শিরোপা জিতেছে মোহামেডান। কিন্তু কোচ মারুফুল হক সেখানে নেই। তার দেখা মিলল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের পূর্বদিকে অবস্থিত বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির বারান্দা দিয়ে হেটে যেতে। ২০০৯ সালে কোটি টাকা প্রাইজমানির প্রথম সুপার কাপের শিরোপা জিতিয়ে দলের আনন্দ উৎযাপনের সঙ্গী হতে না পারা কোচকে বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেড। যে কোচের ক্যারিশমায় শিরোপা জিতেছে পরে আর তার সার্ভিস পায়নি সাদাকালো প্রতিনিধিরা।
তবে সেরা হিসেবে আবাহনীর মতো দলকে পরাজিত করে শিরোপা জয়ের আনন্দ ছিল অনেক বেশি। দর্শকে ঠাসা ষ্টেডিয়ামে ১-০ গোলের জয়টা অনেকদিন মনে থাকার কথা দর্শকদের। ২০০৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে বিডিআর বিদ্রোহের পর মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত ফাইনাল নিয়ে নিরাপত্তায় ছিল বেশ কড়াকড়ি। তবুও দর্শকদের মধ্যে আগ্রহের কোন কমতি ছিলনা। ফাইনাল ম্যাচে মাঠে যত দর্শক উপস্থিত হয়েছিল তার চেয়েও বেশি দর্শক ষ্টেডিয়ামের বাইরে অবস্থান করছিল। আমার স্বরণশক্তি বলছে, দেশের ফুটবলে আবাহনী-মোহামেডান সর্বশেষ দর্শকে পরিপূর্ণ খেলা ছিল এটি। এরপর বহুবার চিরপ্রতিদ্বন্ধী এই দল দুটি মাঠে নামলেও এতটা দর্শকের দেখা মেলেনি।
সে কারণেই আকাশী-নীল আর সাদা কালোর লড়াইটা এখন অনেকটাই কাগুজে। দর্শকদের সেরকম আগ্রহে অনেক বছর আগেই ভাটা পড়েছে। আর এখানে যতটা না দায় আবাহনীর তার চেয়ে বেশি মোহামেডানের। এক যুগের বেশি সময় আগে দেশের ফুটবল পেশাদার যুগে প্রবেশ করলেও এখনো একটি শিরোপা জিততে পারেনি তারা। টানা প্রথম তিন আসরে রানার্সআপ হওয়াটা এখন পর্যন্ত সেরা সাফল্য দলটির। মাঠে শিরোপার দেখা নেই তাই দর্শকও আর আগ্রহ দেখায় না। তবে সুপার কাপের প্রথম শিরোপা আসলেই অন্যরকম এক অর্জন ছিল দলটির।
ঢাকার ফুটবলে কাগুজে হলেও এখনো আবাহনী-মোহামেডান নাম দুটো বড় অর্থ বহন করে। ফুটবল বিশ্লেষকদের বেশিরভাগেরই ধারনা, দেশের ফুটবলের উন্নতি হওয়ার আগে প্রয়োজন এই দুই দলের উন্নতি। আবাহনীর তো আছে, এখন প্রয়োজন মোহামেডানের। এই দুই দলের মাঝে দেশের ফুটবলের বেশিরভাগ আসরের শিরোপা ভাগাভাগি হয়ে আছে। আবার সেই ধারা ফিরে আসলে বাংলাদেশের ফুটবলই এতে উপকৃত হবে। অনেকের কাছে আবাহনী-মোহামেডান লড়াইটা বাংলাদেশের এল ক্লাসিকো!
কারো কারো কাছে আবার এটির নাম ’ঢাকা ডার্বি’। উঁচুতে চোঁখ রাখা মানুষগুলো এতে আপত্তি জানালেও ফুটবলের কথা ভাবলে মেনে নিতেই হবে। হয়তো ইউরোপের ফুটবলের মতো রাত জেগে আর দেশের ফুটবলের কথা কেউ ভাবেন না। অথচ ভাবুন তো, নব্বই দশকেও রাজধানী ঢাকা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যেত এই দুই দলের লড়াইয়ের আগে। মাঠের লড়াই চলে যেত, পাড়া মহল্লায়, অফিস, আদালত, বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মাঠের ফুটবলে গণ্ডগোলের কারণে দর্শকশুন্য গ্যালারীতে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ আয়োজনের রেকর্ড বাংলাদেশের ফুটবলে রয়েছে। ঢাকার মতো চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহেও এই দুই দলের নামে দল গঠন করা হয়েছিল। ফুটবলের ঐতিহ্যকে এই দুই দল ছাড়া তুলনা করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এখন শেখ জামাল, শেখ রাসেল কিংবা বসুন্ধরা কিংসের মতো দলের উত্থান হলেও আবাহনী-মোহামেডানের জায়গা কি তারা নিতে পেরেছে?
মোহামেডানের মতো দল তো মাঠে দর্শকদের ধরে বেঁধে নিয়ে আনেনি। দলের সাফল্যের পাশাপাশি খেলোয়াড়দের নৈপুন্যের কারণেই ধীরে ধীরে দেশের ফুটবলের সবচেয়ে বেশি দর্শক সমৃদ্ধ ক্লাব হয়ে ওঠে মোহামেডান। কে সেরা সেই হিসাব-নিকাশ চলতো দেশের ক্লাব ফুটবলের দুই মহারথী আবাহনী ও মোহামেডানকে নিয়ে। পাড়ার খেলার মাঠ থেকে শুরু করে চায়ের দোকান পর্যন্ত সর্বত্রই তর্ক-বিতর্ক লেগে থাকত। দুই দলেরই নিয়মিতভাবে খেলতেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের বেশিরভাগ ফুটবলার। দুই দলের খেলার ধরনেও ছিল তখন আভিজাত্যের ছোঁয়া।
বিদেশি দেশের কোচরা এসকল ক্লাবের দায়িত্ব নিতেন। ফুটবলের জন্য আলাদাভাবে তৈরি মিরপুর স্টেডিয়াম তখন ছিল আবাহনী সমর্থকদের ঘাটি হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে গুলিস্তানের ঢাকা স্টেডিয়াম মোহামেডানের দখলে থাকত। আকাশী-নীল জার্সির ধারক আর বাহক আবাহনী খেলতো ছোট ছোট পাসে, যা অনেকটা বর্তমানের বার্সেলোনার মতো। অন্যদিকে সাদা-কালো মোহামেডান ঠিক তার উল্টো ষ্টাইলে খেলাটা।
রিয়াল মাদ্রিদের মতো লং পাস করে পাওয়ার ফুটবলের সেরা ছিল তারা। দর্শকদের উন্মত্ত আচরণের কারণে মাঠের পাশাপাশি মাঠের বাইরেও পুলিশকে সর্বদা সজাগ থাকতে হতো। খেলাটি সাধারনের মাঝে কতটা গুরুত্ব পেত এটাই তার প্রমাণ বহন করে। কারণ মাঠের উত্তাপ প্রায়শই ছড়িয়ে পড়তো মাঠের বাইরে। গুলিস্তান, পুরানা পল্টন , বাইতুল মোকাররমসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এই খেলাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের অনেক ঘটনাই ঘটেছে। সংঘর্ষে আহতও হওয়ার নজির তো অহজরহই হতো।
এই যেমন ১৯৮৭ সালে আবাহনী-মোহামেডানের খেলাকে ঘিরে সমর্থকদের সম্ভাব্য সংঘর্ষ ও রক্তপাতের আশঙ্কায় দর্শকশূন্য আর্মি স্টেডিয়ামে খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কতটা উত্তেজনা বিরাজমান থাকলে খেলার মাঠ ছাপিয়ে মাঠের বাইরে এ ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে! ঢাকার ফুটবলের ঐতিহ্যের এই ছবিটাকে কোনভাবেই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
ঐতিহ্যে মোহামেডান এগিয়ে থাকলেও আবাহনী কিন্তু পিছিয়ে ছিলনা। আজকে বাংলাদেশের ফুটবলের এই পিছিয়ে পড়া অনেকের কাছেই বড় এক আক্ষেপের নাম। ১৯৯৩ সালে যেখানে বাংলাদেশের ফিফা র্যাংকিং ছিল ১২০ এখন সেটি ১৮৭! সে সময় ভারতের র্যাংকিং ১২৯ থাকলেও বর্তমানে সেটি ১০১। ৯৩’র র্যাংকিং-এ ১১৭ নম্বরে থাকা ক্রেয়েশিয়া খেলেছে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল। আর বাংলাদেশকে সাফ ফুটবলের প্রথম পর্ব থেকে বিদায় নেওয়ার মতো লজ্জাজনক ঘটনা দেখতে হয়।
এতটা হতাশার মধ্যেই আরো একটি লড়াইয়ে মাঠে নামার অপেক্ষায় রয়েছেন দেশের ফুটবলের দুই জায়ান্ট আবাহনী-মোহামেডান। কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ষ্টেডিয়ামে হারিয়ে যাওয়া ফুটবলের ধ্রুপদী লড়াইয়ে আজ মাঠে নামবে দল দুটি। ম্যাচটি শুরু হবে বিকাল তিনটায়। ২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বরের পর দ্বিতীয়বারের মতো পেশাদার লিগে ঢাকার বাইরে ম্যাচ খেলার অপেক্ষা তারা।
এর আগে ২০০১ সালে রংপুরে জাতীয় লিগে ঢাকার বাইরে প্রথম দুই দল বড় ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল, সেবারও আবাহনী জিতেছিল, ব্যবধান ১-০। মৌসুম শুরুর টুর্নামেন্ট ফেডারেশন কাপের গ্রুপ পর্বের লড়াইয়ে গেল ২৩ ডিসেম্বর ৩-০ গোলের জয়টা পেয়েছিল আবাহনী। ২০১৮-১৯ প্রিমিয়ার লিগে শেষ সাক্ষাতে আবাহনীকে ৪-০ গোলে হারিয়েছিল মোহামেডান। পরের মৌসুমে আবার ৪-০ গোলে মোহামেডানকে হারিয়ে আবাহনী প্রতিশোধ নেয়। আলোকিত আর আলোচিত লড়াইয়ে জয় পরাজয়ের বাইরে সব সময়ই লড়াইয়েল অন্যরকম একটা আবহ থাকেই।
আবাহনী লিমিটেডে জাতীয় দলের ৭ জন খেলোয়াড় থাকার বিপরিতে মোহামেডানে নেই একজনও। শহিদুল আলম সোহলে, রায়হান হাসান, টুটুল হাসান বাদশা, মামুনুল ইসলাম, সোহেল রানা, সাদ উদ্দিন ও নাবীব নেওয়াজ জীবন আকাশী-নীল জার্সিধারীর ভরসার নাম। টানা তিন ম্যাচ জেতা আবাহনী মোহামেডানকে হারিয়ে জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে চান। যদিও ব্রাজিলিয়ান রাফায়েল অগোস্তের পাশাপাশি জীবনকে এই ম্যাচে পাচ্ছেনা ধানমন্ডির জায়ান্টরা।
তারুণ্য নির্ভর মোহামেডানে ভরসার নাম জাপানী উরু নাগাতা ও মালির সোলেমান ডাইবেট। আবাহনীর কোচ মারিও লেমোসের কাছে এই ম্যাচটা অন্য ৮/১০টা ম্যাচের মতো। আর মোহামেডানের শন লেন তারুণ্য দিয়ে জয় ছিনিয়ে আনতে চান। ঢাকা ডার্বির ১৯৭৩ সালে প্রথম ম্যাচেই জয় পেয়েছিল আবাহনী। দুই দল ১২৯ বার মুখোমুখি লড়াইয়ে আবাহনীর ৫৪ এবং মোহামেডান ৪১ ম্যাচে জয় পেয়েছে। ২১ ম্যাচে ড্রয়ের বিপরীতে পরিত্যাক্ত হয়েছে ৩ ম্যাচ। দলের শক্তি, সামর্থ্যে আবাহনী অনেকটা এগিয়ে থাকলেও মোহামেডান রয়েছে অঘটনের আশায়। মোদ্দকথা ৯০ মিনিটের লড়াইয়ে যে দল ভাল খেলবে জয়টা তাদেরই হবে।