ওল্ড ইজ গোল্ড

১৯৯৯ সালের ১৪ অক্টোবর। দিনটির কথা মনে করতে পারেন? সেদিন কি করছিলেন আপনি? হ্যাঁ, লেখাটা যারা পড়ছিলেন তাঁদেরকেই বলছি। বার্ধক্যের কাছাকাছি চলে যাওয়াদের কারো কারো হয়তো তখন তারুণ্য বা যৌবনকাল। আজ যারা কর্পোরেট অফিসের বড় কর্তা তাঁরা হয়তো তখন কেবল মফস্বল শহর থেকে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন হাজারো স্বপ্ন বুকে নিয়ে। কেউ হয়তো তখন হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে যেতেন। কেউ বা বয়সে এতই ছোট ছিলেন যে মনেই করতে পারছেন না সেদিনের কথা। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, ‘ধুর মশাই, সে তো আমার জন্মের আগের কথা!’

কেন ওই দিনটার কথা বলছি। না, তেমন বড় কিছু হয়নি – সেদিন আসলে এক তরুণের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল। মরুর বুকে শারজাহ স্টেডিয়ামে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। সতীর্থদের কেউ এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তো দূরের কথা – মাঠের ক্রিকেটেই নেই। কেউ কোচ, কেউ ধারাভাষ্যকার, কেউ বা বিদেশে প্রবাস জীবনে মানিয়ে নিয়েছেন।

কিন্তু, কি আশ্চর্য্য ব্যাপার, সেদিন সেই অভিষিক্ত তরুণটা আজো খেলছেন, সেটাও আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই। আর খেলছেন বললে ঠিক বোঝা যাবে না বিষয়টার গুরুত্ব। তিনি রীতিমত তরুণদের সাথে পাল্লা দিয়ে পারফরম করছেন তারুণ্যের খেলা বলে পরিচিত টি-টোয়েন্টির ময়দানে, বিশ্বকাপের মত মহাগুরুত্বপূর্ণ আসরে। ভদ্রলোকের নাম শোয়েব মালিক, আর মাস তিনেক পর যিনি ৪০ বছর বয়সে পা রাখবেন।

কথায় আছে পুরো চাল ভাতে বাড়ে। এই ব্যাপারটা ক্রিকেট পাড়ায় প্রমাণ করে চলেছেন পাকিস্তানি ব্যাটার শোয়েব মালিক। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ১৮ বলে ফিফটি করে রেকর্ড গড়েছেন এই অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার।

অথচ টুর্নামেন্টের আগে কি’না তাকে দলে রাখা নিয়ে প্রায় সবারই ছিলো দ্বিমত। স্কোয়াড ঘোষণার বেশ কিছুদিন আগে পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজম এক ফরমায়েশ নিয়ে গিয়েছিলেন প্রধান নির্বাচক মোহাম্মদ ওয়াসিমের কাছে। ফরমায়েশ ছিলো শোয়েব মালিককে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে রাখা। কিন্তু ওয়াসিম এক বাক্যে জানিয়ে দেন, ‘না শোয়েবকে রাখা হবে না, বয়সের কারণে।’

শূন্য হাতেই ফিরেন বাবর। অধিনায়ক হয়তো আঁচ করতে পেরেছিলেন মালিকের মতো অভিজ্ঞ ব্যাটারকে দলে দরকার। কিন্তু প্রধান নির্বাচক এই কথায় কোনো কর্ণপাতই করেননি। এরপর সাবেক বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের হুকুমে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে আসে পরিবর্তন। দলে সুযোগ পেয়ে যান শোয়েব মালিক!

তখন মালিকের ব্যাটে ঠিকঠাক রানও ছিলো না! ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (সিপিএল) কিংবা কাশ্মির প্রিমিয়ার লিগে (কেপিএল) খুব হতাশাজনক পারফরম্যান্সই তিনি করেছিলেন। তাই বয়স নিয়েই যেনো সমালোচনাটা খুব বেশি ছিলো। বুড়ো বয়সে ফর্মহীন মালিককে দলে নেওয়াটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এমন মন্তব্য করেছেন অনেকে।

সমালোচনার জবাবটাও ব্যাট হাতেই দিচ্ছেন এই পাকিস্তানি ব্যাটার। প্রায ৪০ ছুঁইছুই বয়সে এসেও গড়েছেন রেকর্ড। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে আনুষ্ঠানিকতার ম্যাচে ১৮ বলে অপরাজিত ৫৪ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন তিনি। ৬ ছক্কা ও ১ চারে শারজাহ স্টেডিয়ামে তাণ্ডব চালান শোয়েব। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ইতিহাসে দ্রুততম ফিফটির তালিকায় লোকেশ রাহুলের সাথে যৌথভাবে চারে আছেন শোয়েব। এবারের আসরের দ্রুততম ফিফটির রেকর্ডেও সবার উপরেই আছেন তিনি।

তবে পাকিস্তানের হয়ে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে এটি দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড। এর আগে ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে উমর আকমল করেছিলেন ২১ বলে ফিফটি। চলতি আসরে এখন পর্যন্ত পাঁচ ম্যাচে তিন ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছেন মালিক। আর এই তিন ইনিংসে ৯৯ গড়ে ১৮৭ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন ৯৯! এর মাঝে দুই ম্যাচে রেখেছেন দলের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

শোয়েব ব্যাট হাতে দিলেন সব সমালোচনার জবাব। বয়সটা যে স্রেফ সংখ্যা মাত্র সেটাও জানান দিলেন ব্যাট হাতেই। বাবর আজমযে ভুল কিছু চাননি সেটার প্রমাণও মালিক। অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে দলকে নিজের সবটাই দিচ্ছেন তিনি।

২২ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ার! তাঁর সাথের অনেকেই ব্যাট-প্যাড তুলে অবসরে আছেন। কেউ বা কাজ করছেন ক্রিকেট বোর্ডে। কিন্তু এখনো ফিটনেস ধরে রেখে খেলে চলেছেন মালিক। চেহারায় বয়সের ছাপ কিংবা ক্লান্তি কোনোটাই নেই। ফিটনেসেও নেই কমতি! স্রেফ বয়সেই দোহাই দিয়ে কাউকে দমিয়ে রাখা যায় না তার প্রমাণ খোদ মালিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link