দৌঁড়াচ্ছেন, না ঠিক দৌঁড়াচ্ছেন না। যেন, স্লো-মোশনে এক ডিফেন্ডার পা চালাচ্ছেন একজন ডিফেন্ডার — পায়ের ছোঁয়ায় বল কেড়ে নিচ্ছেন, সময়ের গতিকে থামিয়ে দিয়ে! চেহারায় কোনও অহংকার নেই, গায়ে ঝুলে থাকা ১৩ নম্বর জার্সি। ক্যামেরা ঘুরতেই দেখা যায়, তিনি আলেসান্দ্রো নেস্তা। ভিড়ের মধ্যে থেকেও একা!
ফুটবল এক রকমের যুদ্ধ। আর প্রতিটি যুদ্ধে থাকে সৈন্য, সেনাপতি এবং কিছু ভুলে যাওয়া নায়ক। তিনি ছিলেন দেয়াল, প্রতিপক্ষের দু:স্বপ্ন, তবু নামটা যতটা উচ্চারিত হওয়ার কথা ছিল, হয়নি। তিনি হলেন আলেসান্দ্রো নেস্তা।
ইতালি মানেই রক্ষণাত্মক ফুটবলের আদর্শ ব্যাখ্যা। তাদের কাছে ফুটবল মানে যুদ্ধ, আর যুদ্ধ মানেই আগে দুর্গ গড়া, তারপর অস্ত্র তোলা। সেই দুর্গের দেয়াল হয়ে যারা দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের কেউ কেউ ইতিহাসের আলোয় ঝলমল করেছেন, কেউ রয়ে গেছেন ছায়ায়।
আলেসান্দ্রো নেস্তা— এক নিখুঁত শিল্পী, যিনি নিজের কাজটা এতটাই নি:শব্দে করতেন যে, তার মাহাত্ম্য বোঝা যেত কেবল তখনই, যখন তিনি অনুপস্থিত থাকতেন।
রোমের ছেলেটি যখন লাজিওর জার্সি গায়ে তুললেন, তখন থেকেই বোঝা গিয়েছিল— রক্ষণ আর্টও হতে পারে। ট্যাকল করা, বল কেড়ে নেওয়া, সময়ের আগে বুঝে ফেলা বিপদ কখন আসছে— এসব যেন তার সহজাত প্রতিভা। তারপর এসি মিলান, তারপর সেই বিখ্যাত ১৩ নম্বর জার্সি।
এসি মিলানে তখন আনচেলোত্তির সোনালি যুগ। ৪-৩-২-১ ফরমেশন, বিখ্যাত ‘ক্রিসমাস ট্রি’। কাফু-জানকুলভস্কি যখন আক্রমণে উঠে যেতেন, তখন পেছনে শিলাখণ্ডের মতো দাঁড়িয়ে থাকতেন নেস্তা আর মালদিনি। যেন রোমের দুই মহারথী— একদিকে অভিজাত সৌন্দর্য, অন্যদিকে কার্যকারিতার চরম রূপ।
কিন্তু ইতিহাস বড়ই একপেশে। পাওলো মালদিনি হয়ে উঠলেন ফুটবলের কবিতা, কানাভারো ব্যালন ডি’অর হাতে তুললেন। আর নেস্তা? তিনি রয়ে গেলেন নি:শব্দ এক সৈনিক হয়ে।
২০০৬ বিশ্বকাপের কথা ধরো। ইতালির রক্ষণ যখন অজেয় দুর্গ হয়ে উঠেছিল, তখন সেই দেয়ালের ভিত্তি ছিলেন নেস্তা। কিন্তু ফাইনালে তার নাম কোথায়? ইতিহাস শুধু বলে, কানাভারো কাপ উঁচিয়ে ধরলেন, বুফন উল্লাস করলেন। নেস্তার নামটি খুঁজতে গেলে খেলার শুরুর দিকের ম্যাচগুলোয় যেতে হবে, দেখতে হবে কীভাবে ব্রাজিলিয়ান রোনালদো, ফ্রান্সের অঁরি বা জার্মান ক্লোজাদের কাছে রীতিমতো দু:স্বপ্ন হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
নেস্তার খেলায় ছিল না অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক রক্ষণ, ছিল না বাহুল্যতা। তিনি স্রেফ কাজটা করতেন— নিখুঁতভাবে, পরিপাটি করে। তার ট্যাকল মানে বলের ওপর চিরকুট লেখা, ‘এখানে আসা নিষেধ।’
তবু লাইমলাইট তার জন্য ছিল না। হয়তো এটাই নিয়ম। সবাই তো আর অর্জুন হন না, কেউ কেউ কর্ণও হন। কর্ণ হয়েও তিনি জিতেছেন। লাজিওতে কোপা ইতালিয়া, এসি মিলানে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ইতালির হয়ে বিশ্বকাপ— সব কিছুই এসেছে। কিন্তু কখনও কি ফুটবল তাকে তার যোগ্য স্বীকৃতি দিয়েছে?
যখন ফুটবলপ্রেমীরা লিজেন্ডদের তালিকা করেন, তখন নেস্তার নাম আসতে একটু দেরি হয়। হয়তো অনেকেই ভুলে যান। কিন্তু, বল জানে। প্রতিপক্ষ স্ট্রাইকারেরা জানে। আর মাঠের সবুজ ঘাস জানে— আলেসান্দ্রো নেস্তা ছিলেন, আছেন, থাকবেন। নি:শব্দ এক বিপ্লবী হয়ে, নিখুঁত এক রক্ষাকবচ হয়ে।