২০০০ সাল। ধানমন্ডির আবাহনী মাঠে এক শীতের সকাল। ঢাকা মেট্রোর বিপক্ষে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হলো বাংলাদেশের এক ক্রিকেট নক্ষত্রের। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যার ঝুলিতে আছে নয় হাজারেরও বেশি রান। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে যা তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তগত সংগ্রহ। তবে ব্যাট হাতে ৯১৩৮ রান এবং বল হাতে ২০০ উইকেট আছে এমন ক্রিকেটারের একটা তালিকা করলে একটা নামই আসবে, অলক কাপালি।
অনেকের মতেই অলক কাপালি তাঁর প্রতিভার ছিটেফোঁটাও দেখাতে পারেননি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। তবে টেস্ট ক্রিকেটেও ব্যাট হাতে অলক কাপালির শুরুটা ছিল অনবদ্য। প্রথম সাত টেস্ট ইনিংসে তাঁর স্কোর যথাক্রমে ৩৯, ২৩, ৩৫, ১০, ৩৮, ২৩ ও ৫২। সেই সময়ের বাস্তবতায় অলক কাপালির এই ইনিংস গুলো ছিল একেকটি মহাকাব্য। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আলোচনার খোঁড়াক।
অলক কাপালি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ২০০৩ সালে দেশের প্রথম বোলার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক করার জন্য। সেদিন ছিল তাঁর জন্মদিন। তবে ১৯ বছর পর আজ আরেকটি জন্মদিনে অলক কাপালি ইতি টানলেন নিজের প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারের। সেই ২০০৬ সালেই সর্বশেষ টেস্ট ম্যাচটা খেলে ফেলেছিলেন। তবে এবার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটকেও বললেন বিদায়।
আর কিছুদিন খেললে হয়তো প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১০ হাজার রানের মাইলফলকটা ছুঁতে পারতেন তিনি। সেই স্বপ্নও তাঁর ছিল। তবে অলক কাপালি জায়গাটা ছেড়ে দিচ্ছেন সিলেটের তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য। তিনি চান নতুনরা উঠে আসুক সিলেট থেকে, যারা বাংলাদেশের হয়েও খেলবে।
হঠাতই এমন বিদায়ের কারণ জানতে চাইলে অলক কাপালি খেলা ৭১-কে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আসলে আমি চাই সিলেট থেকে নতুন ব্যাটসম্যানরা উঠে আসুক। সামনে তো দল দেয়া হবে। আমি অবসর না নিলে স্বাভাবিকভাবেই আমাকে দলে রাখা হবে। সেজন্যই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া। আমার জায়গায় যেন নতুন একটা ছেলে সুযোগ পায়। এখনো যদি চিন্তা থাকে যে অলক কাপালিই খেলবে তাহলে তো সেটা দেশের জন্য ভালো না।’
প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেললেন অলক কাপালি। এই পুরো পথটা কেমন ছিল বলতে গিয়ে খানিকটা আবেগীই হয়ে পড়েন তিনি। বলছিলেন, ‘লাল বলের ক্রিকেটটা আসলে আমার জন্য অন্যরকম একটা অনুভূতি। আমরা তো শুরুতে সব সাদা পোশাকেই খেলতাম। এই জায়গাটা আসলে আমি অনেক মিস করবো। কিন্তু সিলেট থেকে এখন সেভাবে ব্যাটসম্যান উঠে আসছেনা। আমি চাই তরুণরা আরো বেশি করে খেলুক, যাতে ওরা একসময় বাংলাদেশের হয়ে খেলতে পারে।’
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দশ হাজার রানের মাইলফলক ছুঁতে অলক কাপালির প্রয়োজন ছিল আর অল্প কিছু রান। মাইলফলকটা তিনি চাইলেই হয়তো ছুঁয়ে ফেলতে পারতেন। সেটা হলে কী আরো একটু ভালো লাগতো কিনা এই ব্যাটারের?
অলক কাপালি বলছিলেন, ‘হ্যাঁ, সেটা ঠিকাছে। আবার অনেক কিছুই পেয়েছি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে। এখনো কিন্তু আমার হাইয়েস্ট তিনটা ডাবল সেঞ্চুরি আছে। দশ হাজার রান করবো সেই ইচ্ছাও ছিল। কিন্তু আমি হঠাৎ করে বিসিএল থেকে যখন বাদ পড়ে যাই তখনই ভেবেছিলাম ছেড়ে দিব। বুঝতে পারছিলাম যে তাঁরা আমাকে নিয়ে আর ভাবছে না। তাই গতবছরই ছেড়ে দিব ভেবেছিলাম, আমার আবার ইনজুরি ছিল। এবার আর কি শুরু হবার আগেই ছেড়ে দিলাম। আমার এখন মনে হয় আমি ১০ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করার চেয়ে একটা নতুন ছেলে যদি ভালো খেলতে পারে সেটা দেশের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মোট ১৭২ টি ম্যাচ খেলেছেন অলক কাপালি। তাঁর থেকে বেশি ম্যাচ খেলেছেন মাত্র দুজন। ফলে একজন ক্রিকেটার হিসেবে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটটাকে তিনিই সবচেয়ে ভালো বোঝেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের মান ও সুযোগ সুবিধা নিয়ে অলক কাপালি বলছিলেন, ‘মানে দিকটায় আমি মনে করি এখন অনেক উন্নতি হয়েছে। আগের মত পিকনিক ক্রিকেট আর বলা যায়না। তবে ক্রিকেটাররা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলে যে টাকা পায় সেটা আসলে যথেষ্ট না। এটা যদি বাড়ে তাহলে হয়তো আরো অনেকে ক্রিকেটের দিকে আসবে। তখন আরো ভালো মানের ক্রিকেটার পাওয়া যাবে।’
তবে টেস্ট ক্রিকেটে এগিয়ে যাবার জন্য বিভাগীয় ক্রিকেট সংস্থাগুলোকে আরো বেশি সচেতন হবার পরামর্শ দিয়ে গেলেন অলক কাপালি। ক্রিকেটারদের নিয়ে আরো অনেক কাজ করার আছে বলে মনে করেন তিনি। বিভাগীয় ক্রিকেট সংস্থাগুলোর কাজ নিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘গত বছর খেলা শেষ হবার পর সবাই যে বাড়ি চলে গেল এরপর আর সেই ক্রিকেটারদের নিয়ে বিভাগ গুলো কোন কাজ করেনা। আবার খেলার ১০-১৫ দিন আগে একটা ক্যাম্প হবে। এভাবে তো আসলে ক্রিকেটার তৈরি হয়না। অন্তত ২-৩ মাস তাঁদের নিয়ে কাজ করা উচিৎ। এইদিকে আরেকটু নজর দেয়া উচিৎ আমি মনে করি।’