প্রত্যেক সিনেমার একটা ভার্ডিক্ট থাকে। প্রেক্ষাগৃহে সেটি কেমন চলল তা বুঝা যায় ব্লকবাস্টার, সুপার হিট, সেমিহিট, এভারেজ, বিলো এভারেজ ভার্ডিক্টেই। একটু জোরপূর্বক সাদৃশ্যতা টেনে আনা হতে পারে। তারপরও আপনার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) কেমন ভার্ডিক্ট পাবে?
ক্রিকেটের পাড়ভক্ত না হলেও চলবে। এটা নিশ্চিতই যে, বিপিএল যেভাবে সমালোচনার সমুদ্রে ডুবে থাকে তাতে সেটি ন্যূনতম সেমিহিট লিগও নয়। কোনো ভাবে টেনেটুনে বিলো এভারেজ লিগ বলা যেতে পারে। আবার অনেকের কাছে এটি আবার ‘ডিজাস্টার’ লিগও মনে হতে পারে। যা হোক, বিপিএল শব্দ সংক্ষেপের সাথে মিলিয়ে বিলো এভারেজ প্রিমিয়ার লিগের শত সমস্যা, সম্ভবনা নিয়ে আপাতত একটা খেরোখাতা দাঁড় করানো যাক।
বাংলাদেশে ক্রিকেটের বাজারটা বেশ বড়ো। অন্তত অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডকে টেক্কা দেওয়ার মতো অবস্থা তো অনেক আগেই হয়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় এই বাজারটায় বিসিবি’র বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। একটা বিপিএল আসে, শেষ হয়। কিন্তু তেমন ক্রেজ তৈরি করতে পারেনা বিসিবি। এর পিছনের কারণটা হলো অবকাঠামোগত দুর্বলতা, একই সাথে প্রশাসনিক অদক্ষতাও বটে।
বিসিবি প্রধান বেশ ক’বারই বিপিএলকে এক ধরনের বোঝা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অর্থাৎ এই নির্দিষ্ট টুর্নামেন্টটার উপরে বিসিবি’র দৃষ্টিও তেমন জোরালো নয়। তাই দিনশেষে ঐ ‘যা তা’ বিপিএলেই শেষ হয় প্রত্যেকটা আসর।
এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শুরু থেকেই বিপিএলের সঙ্গী হয়েছে শত সমালোচনা। আধুনিক যুগের ক্রিকেট কোন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগটায় ডিআরএসের ব্যবহার নেই? একটু কৌতুক করে বললে, সেই একমাত্র লিগটার নাম বিপিএল। যেন মান্ধাতার আমলের সিস্টেমটাকে একটু পুঁজি করে চলা আরকি। নয়তো দায়সারা ভাবে টুর্নামেন্ট শেষ করার প্রচেষ্টা।
বিপিএল গভার্নিং কাউন্সিল থেকে বরাবরই জানানো হয়েছে, ডিআরএসের সব উপকরণ তাদের আছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে কোম্পানি আছে তাদের সময় মিলছে না। অথচ একই সাথে চলমান আইএলটি-২০, কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় এসএ টি-২০তে ঠিকই ডিআরএসের দেখা ঠিকই মিলেছে।
মূলত এখানেই থলের বেড়াল বেরিয়ে আসে। বিপিএল মূলত সাময়িক পরিকল্পনার ফসল। এর পিছনে দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা নেই বিসিবি’র। অন্যান্য লিগ গুলো নিয়ে অনেক আগেই আয়োজন নিয়ে পরিকল্পনা সাজানো থাকে। বিসিবি এখানেই থেমে থাকে। মাস দুয়েক একটা তোড়জোর শুরু হয়। প্লেয়ার্স ড্রাফট হয় তড়িঘড়ি করে। এরপর সময় যেতে না যেতেই বিপিএল শুরুর ক্ষণ ঘনিয়ে আসে।
ফলে যা হওয়ার তাই-ই হয়। বিপিএল নিয়ে স্বয়ং একটা দলের অধিনায়কও হাস্যরসাত্বক মন্তব্য করে বসেন। কিন্তু এমন অপেশাদারিত্বও যেন গ্রহনযোগ্য হয়ে পড়ে অবকাঠামোগত ব্যর্থতায়। কারণটা ঐ যে, বিসিবি বিপিএল আয়োজনই করে শত ফাঁকফোকর রেখে। একটু মজা করে বললে, বিপিএলের অর্গানিক প্রমোশন হয় আবার এই নেগেটিভ মার্কেটিং প্রক্রিয়াতেই।
সিলেট, চট্টগ্রামের মানুষ তাদের শহরে বিপিএল দেখতে ভিড় করে। এমন দৃশ্যের কথা টেনে বিসিবিও নিজেদের সফল হিসেবে দাবি করে। হয়ও বটে। টিকিটের বাজারে তাদের লাভ হয়। কিন্তু হয় না যেটা, টুর্নামেন্টের মানোন্নয়ন। এক দশক পেরিয়ে গেলেও বিপিএল রয়ে যায় সেই তিমিরেই।
এবারের বিপিএলটাই নির্দিষ্ট করে চোখ দেওয়া যাক। যথারীতি আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ককে সঙ্গী করে বিপিএল মাঠে গড়াল। কিন্তু আয়োজকরা শুরুই করলো অদ্ভুত এক কান্ড দিয়ে। সময় পরিবর্তন হলো। কিন্তু সেটি নিয়ে কোনো প্রচারণা নেই। ব্যাপারটা অনেকটা পাড়ার ক্রিকেটের মতো। দুই দলকে সব জানিয়ে দেওয়া হলো। ব্যাস ওতেই শেষ।
সময় বিভ্রাট পিছনে ফেলে বিপিএল চলতে শুরু করলো। কিন্তু যে লিগ নিম্ন মানের, তার দৃশ্যায়নটাও তো তেমনই হওয়ার কথা। আম্পায়ারিং বিতর্কে সাকিব তেড়েফুঁড়ে গেলেন। বিকট চিৎকারে যেন বুঝিয়ে দিলেন, যেমন বিপিএল তেমন আচরণ। আম্পায়াররাও যেন সাকিব আগ্রাসনে বড্ড অসহায়। ম্যাচ রিপোর্টে কোন আচরণবিধি লঙ্ঘন করার কথা উল্লেখ নেই।
কিন্তু আম্পায়ারদের প্রকৃত আচরণ আবার ফুটে উঠে অন্য ক্রিকেটারদের বেলায়। এনামুল, সৌম্যরা তাদের দেওয়া সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করেন। ফলাফল, আর্থিক জরিমানা কিংবা ম্যাচ ফি’র কিছু অংশ কেটে নেওয়া। কোচ সালাউদ্দিন প্রকাশ্যে হতাশা করলেও মেলে সেই একই চিত্র। আম্পায়াররা নিজেদের আধিপত্য বুঝিয়ে দেন। কিন্তু সাকিবের বেলায় নিশ্চুপ না থেকে যেন উপায় নেই। অবশ্য এমন দ্বৈত নীতি তো বিসিবিও করে। অন্যান্য ক্রিকেটারদের বেলায় যত কড়া, সাকিবের বেলায় যেন ঠিক তেমন ভীতু।
বিপিএলের সরস গল্পের এখানেই শেষ নয়। ক্রিকেট ইতিহাসে কখনো খেলোয়াড়ের অনুরোধে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হতে দেখা গিয়েছ? কিন্তু এমন নজির বিপিএলে ঘটে। এবারেই তা হয়েছে। খুলনার বিপক্ষে ঢাকার এক ম্যাচে সৌম্য সরকার আউট। কিন্তু সেটাই পরে পরিবর্তিত হয়ে যায় সৌম্যর আকুতি মিনতিতে। তামিম তখন বিষ্ময় চোখে শুধু তাকিয়ে ছিলেন। হয়তো বিপিএলটাই এমন। অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকীর্তি তাকিয়ে দেখা ছাড়া উপায় নেই।
আগেই জানা গিয়েছিল, আগামী তিন বছরের চুক্তিতে এবারের দলগুলো দল সাজিয়েছে। অথচ দলগুলোর বিদায় ঘন্টা বাজার সাথে সাথে কোনো কিছুই এখন নিশ্চিত নয়। যেমনটি করে বিপিএল কর্তৃপক্ষও নিশ্চিত নয় যে, আগামী বিপিএল কোনো স্লটে করবে তারা।
চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স অধিনায়ক শুভাগত হোম টুর্নামেন্ট শেষে বলেছেন, চুক্তি নিয়ে তাঁর জানা নাই। তাদের সাথে এক বছরের চুক্তিতে নাকি কথা হয়েছে। আবার ঢাকা ডমিনেটর্স অধিনায়ক নাসিরও চুক্তির ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো বার্তা দিতে পারেননি। ফরচুন বরিশালের মালিক তো প্লে অফে হারার পর জানিয়েই দিয়েছেন, আগামীবার তারা খেলবেন কিনা নিশ্চিত নয়।
সব মিলিয়ে বিপিএল সাজিয়ে গুছিয়ে করার যে পরিকল্পনা হয়েছিল, তা এক প্রকার বিফলেই যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। বরিশাল ফ্রাঞ্চাইজি তো আরেক কাঠি সরেস। ম্যাচ হারার পর তারা তাদের অধিনায়ক সাকিবকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। এমন নজির ইতিহাসে সম্ভবত অশূণ্য বিপিএলের এমন কাণ্ডকারখানায় বদৌলতে।
বিপিএল যখন শুরু হলো তখন সারাবিশ্বে আরো তিনটা ফ্রাঞ্চাইজি লিগ চলছে। এর মাঝে বিপিএল করার মানে কী? উত্তরটা সোজা- আর কোনো স্লট ফাঁকা ছিল না। হ্যা। এই কারণটা যৌক্তিক। কিন্তু বিসিবি’র আদৌ কি বিপিএল নিয়ে কোনো ভাবনা রয়েছে? একটা বৈশ্বিক মানের টুর্নামেন্ট করার সদিচ্ছা কি আছে? এই প্রশ্নগুলো থেকেই যায়। কারণ টুর্নামেন্টের আয়োজক থেকে শুরু করে খেলোয়াড়, ফ্রাঞ্চাইজি, কেউই কারো চেয়ে দিনশেষে কম নন।
পেশাদারিত্ব যেমন ফ্রাঞ্চাইজি গুলোর নেই ঠিক তেমনভাবে খেলোয়াড়দেরও দায় আছে। এক টুর্নামেন্টে ক্রিকেটারদের এত কোড অফ কন্ডাক্ট ভাঙাকে নিশ্চয় বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া যায় না। আর বিপিএল আয়োজক কর্তৃপক্ষ তো শুরু থেকেই উদাসীন। কোনো ভাবে উতরে যাওয়ার প্রচেষ্টায় থাকে তারা। তাই বিপিএলের মানটাও নিচের দিকেই থাকে।
এতশত ‘না’ পাওয়ার ভীড়ে এবারে দেশি তরুণ ক্রিকেটাররা পারফর্ম করছে। এটাই যেন পরম পাওয়া। তাছাড়া, দেশি পেসাররা তাদের জাত চেনাতে পেরেছেন। আক্ষেপভরা বিপিএলে অর্জন এতটুকুই। অন্তত শুরুর ‘যা তা’ বিপিএল তাদের জন্য কিছুটা হলেও মার্কস পাবে। তবে তা কোনোভাবেই ‘হিট’ নয়। সেমিহিটও নয়। কোনো ভাবে টেনেটুনে বিলো এভারেজ। এখন এই বিলো এভারেজ ট্যাগ থেকে কি সামনে আরো উপরে উঠতে পারবে বিপিএল?
উত্তরটা স্পষ্টভাবে দিলে, ‘না’। তবে সঠিক পরিকল্পনা থাকলে দারুণ কিছু করা সম্ভব। কিন্তু সেই ভাবনার প্রতিফলন কোনো বারেই মেলে না। তাই একটা ‘যা তা’ বিপিএল ‘যা তা’ নামক বিরক্তির শব্দের বেড়াজালে আটকে থেকেই শেষ হয়। এখান থেকে উত্তরণের আশাও আপাতত ক্ষীণ।