একটা অসমাপ্ত ছেলেমানুষি

যুবরাজ সিং এক প্রজন্মের হঠাৎ থেমে যাওয়া হৃদস্পন্দন। একটা ব্যাটের সুইং। একটা চোখের আগুন। একটা অসমাপ্ত ছেলেমানুষি—যা আজও বড় হতে দেয়নি একটি প্রজন্ম।

সময় ঠিক যেন কভার ড্রাইভ—নমনীয়, নির্ভুল, অথচ জেদি। কিছু স্মৃতি তাই ঘুরে ফিরে আসে অফ স্টাম্পের বাইরে পড়ে থাকা বলে, যাকে ছেড়ে দেওয়া যায় না—যুবরাজ সিং তেমনই এক স্মৃতি।

শচীন টেন্ডুলকারের ব্যাট ছিল ধ্যানমগ্ন। সৌরভ গাঙ্গুলির ডাউন দ্য উইকেটে ছিল রূপকথা। রাহুল দ্রাবিড়ের ডিফেন্সে স্থিরতা। আর যুবরাজ ছিলেন খোলা জানালায় উড়ে আসা হাওয়ার মতো—অসাবধান, অবাধ্য, কিন্তু তরতাজা।

২০০০ সালের মোহাম্মদ কাইফ ও যুবরাজের যুগপৎ উত্থান ঘটেছিল এক ভাঙনের ঠিক পরপর। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের কালো ছায়া যখন ভারতীয় ক্রিকেটকে ঠেলে দিয়েছিল অস্তিত্ব সংকটে, তখনই উদয় হলেন এক বাঁহাতি ব্যাটার, যাঁর চোখে ছিল আত্মবিশ্বাস।

প্রথম চিত্রটা স্পষ্ট— নাটকীয় শর্ট বল। জেসন গিলেস্পির স্পিড পেছনে ফেলে বাঁ পায়ে হেলিয়ে একটি পুল শট গ্যালারিতে। তারপর স্টিভ ওয়াহকে মিডউইকেটে উঠিয়ে দেওয়া, গ্লেন ম্যাকগ্রাকে স্কয়ার কাট —  একেকটা স্ট্রোক, একেকটা বার্তা। ক্রিকেট বুঝে গেল—ব্যাটিং কেবল পরিসংখ্যান নয়, ব্যাটিং হতে পারে একধরনের বিদ্রোহ। যুবরাজ সেই বিদ্রোহের নাম।

লর্ডস ২০০২, ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনাল। সতর্ক ব্যাটিংয়ের বিপরীতে এক হঠকারী সাহস। যেখানে প্রতিপক্ষ হিসেব কষছে, সেখানে ইনিংস গড়ে উঠল অঙ্কের বাইরের ভাষায়।
১৪৬-৫ থেকে ফিনিশিং টাচে পৌঁছানোর গল্পে একটা ইনিংস বদলে দিল ভারতের ক্রিকেট মানসিকতা।

তারপর এলো ২০০৭—টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ছয় বলে ছয় ছক্কা। স্টুয়ার্ট ব্রডের মাথার ওপরে ঘুরল সেই ছয়টি বল, ক্রিকেট বোঝাল, গৌরব কখনও কখনও স্প্যানডেক্স পড়ে আসে।

বিশ্বকাপ ২০১১— যেখানে একজন ক্রিকেটার শারীরিকভাবে অসুস্থ থেকেও  ব্যাট, বল, ফিল্ডিং—সবই যেন যুবরাজ হয়ে উঠেছিল এক পরিপূর্ণ অস্ত্র। উইকেটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি যেন দাঁড় করিয়েছিলেন এক স্বপ্নের প্রতিরক্ষা।

তবে সবচেয়ে শক্ত ইনিংসটি মাঠে নয়, মাঠের বাইরে— ক্যান্সারের বিরুদ্ধে জয়। ক্রিকেট বোঝাল, একজন ব্যাটসম্যান শুধু বোলারকে হারায় না, সময়কেও হারায়।

তাঁর ব্যাট থামলেও ব্যাটের সুইংটা এখনও বাতাসে বাজে। বাজে লেগস্টাম্পের পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া বলের মতো হারিয়ে যাওয়া এক কৈশোরে।

আজও যখন কোনো বাঁহাতি মিডল অর্ডার ব্যাটার মিডউইকেটের ওপর দিয়ে বলটা ওড়ায়— তখন বোঝা যায়, যুবরাজ থামেননি। অফ স্টাম্পের বাইরের এক বলের মতোই তিনি আছেন, একটু ছুঁয়ে যাওয়া যায়, পুরোটা ধরা যায় না। যাব তাক বাল্লা চাল রাহা হ্যায়, ঠাঁট হ্যায়!

যুবরাজ সিং এক প্রজন্মের হঠাৎ থেমে যাওয়া হৃদস্পন্দন। একটা ব্যাটের সুইং। একটা চোখের আগুন। একটা অসমাপ্ত ছেলেমানুষি—যা আজও বড় হতে দেয়নি একটি প্রজন্ম।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Share via
Copy link