কিয়েভ কিংবা মিলানের ধ্রুবতারা

সেই মিলানের ভরসার জায়গা বনে যেতে খুব বেশি কালক্ষেপন করেননি শেভচেঙ্কো। অভিষেক মৌসুমেই ইতালিয়ান ক্লাব ফুটবলের সর্বোচ্চ শিরোপা সিরি ‘এ’ জেতার স্বাদ পেয়ে যান তিনি। লিগে ৩২ ম্যাচ খেলতে নেমে ২৪টি গুরুত্বপূর্ণ গোলও করেছিলেন শেভচেঙ্কো।

সুদূর প্যারিসে বসে কবি মাইকেল মধূসুদন দত্ত লিখেছিলেন,

সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে

সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।

ইংল্যান্ডে থাকা ইউক্রেনের কিংবদন্তি ফুটবলার আন্দ্রে শেভচেঙ্কোর মনেও হয়ত স্বদেশ কাতরতা জেগেছে এখন। যে দেশের মাটিতে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। যে মাটিতে তাঁর ছোট্ট পা খানা ফুটবলকে প্রথম আপন করে নিয়েছে সেই দেশটা রয়েছে আজ সংকটে। নিদারুণ সংকট। তবে সংকটে কাটেনি শেভচেঙ্কোর ফুটবল ক্যারিয়ার। তিনি ছিলেন ইউরোপ সেরা, তিনি ছিলেন ইউক্রেনের সর্বকালের সেরা।

১৯৭৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ইউক্রেনে জন্ম নেন ইউক্রেন ফুটবল ইতিহাসের সেরা স্ট্রাইকার অ্যান্দ্রে শেভচেঙ্কো। ইউক্রেনে রাজধানী কিয়েভের এক স্কুলে কাটান নিজের শৈশব। সে স্কুলের বন্ধুদের সাথেই হয়ত ফুটবলে প্রথম লাথি মারাটা রপ্ত করেছিলেন শেভচেঙ্কো। সেখান থেকে ধীরে ধীরে ফুটবল পরিণত হয়ে যায় ধ্যান ও জ্ঞান।

রাজধানীর ক্লাব ডায়নামো কিয়েভের যুব দলের হয়ে পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন শেভচেঙ্কো। ১৯৯৩-৯৬ এই তিনি বছর ছিলেন যুব দলের সদস্য। তবে মাঝেসাঝেই মূল দলে জায়গা হয়েছিল তাঁর। সেদিক বিবেচনায় ডায়নামো কিয়েভের হয়ে তাঁর ক্যারিয়ারের দৈর্ঘ্য বছর ছ’য়েকের। এ সময়ে যুব দল ও মূল দলের হয়ে ১৬৮ ম্যাচ খেলে করেছিলেন ৫৬ গোল। তখন তারকা হয়ে ওঠা বাকি। তখনও বাকি পারি দেওয়া লম্বা এক পথ।

১৯৯৯/২০০০ মৌসুমে তিনি যোগ দেন ইতালিয়ান ক্লাব পরাশক্তি এসি মিলানে। সেখান থেকেই উত্থান এক লিথ্যাল স্ট্রাইকারের। পুরাদস্তুর একজন বক্স টু বক্স স্ট্রাইকার ছাড়াও বাম পাশের উইং দিয়েও অ্যাটাক করতে দারুণভাবে পটু শেভচেঙ্কো ক্রমশই ইউরোপীয় ফুটবলের উজ্জ্বল তারকার একজনে পরিণত হতে শুরু করেন। তাঁকে তখনকার সময়ে রেকর্ড ২৫ মিলিয়ন ইউরোতে দলে ভিড়িয়েছিল মিলান।

সেই মিলানের ভরসার জায়গা বনে যেতে খুব বেশি কালক্ষেপণ করেননি শেভচেঙ্কো। অভিষেক মৌসুমেই ইতালিয়ান ক্লাব ফুটবলের সর্বোচ্চ শিরোপা সিরি ‘এ’ জেতার স্বাদ পেয়ে যান তিনি। লিগে ৩২ ম্যাচ খেলতে নেমে ২৪টি গুরুত্বপূর্ণ গোলও করেছিলেন শেভচেঙ্কো। থেমে যাওয়ার জন্য তিনি যাননি ইতালিতে। নিজেকে প্রমাণ করতেই গিয়েছিলেন সেখানে। পরের মৌসুমে সব ধরণের প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ মিলিয়ে মিলানের হয়ে ৫১ বার মাঠে নেমেছিলেন শেভচেঙ্কো।

৫১ বার এসি মিলানের সেই জার্সি গায়ে জড়িয়ে তিনি ৩৪ বার খুঁজে পেয়েছেন জালের ঠিকানা। তাঁকে নিয়ে সরব হতে থাকে ইউরোপের ফুটবল অঙ্গন। আর তিনি নিজেকে যে আরও পরিণত করার চেষ্টাটা চালিয়ে যেতে থাকেন। তবে ফুটবলারদের ক্যারিয়ারে যমদূত ইনজুরি বারেবারে হানা দিতে থাকে শেভচেঙ্কোর দিকে। তিনি কোনমতে সেসব কিছু সামলে ২০০২-০৩ মৌসুমে জিতে নেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ।

সে মৌসুমে ইনজুরির বাগড়া সত্ত্বেও তিনি ১০টি গোল করেছিলেন। যেখানে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইন্টার মিলানের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাওয়ে গোলও ছিল। দুই মৌসুম ইনজুরির সাথে দহরম মহরম চলে তাঁর। পরিত্রাণ পান ২০০৩-০৪ মৌসুমে। এরপর মিলানে যতদিন কাটিয়েছেন মৌসুম শেষ করেছেন অন্তত ২৬ গোল কিংবা বেশি গোল করে।

দারুণভাবে পারফর্ম করে যাওয়া শেভচেঙ্কোর ডাক আসে ইংলিশ ক্লাব চেলসি থেকে। গুঞ্জন আছে ২০০৫ এর গ্রীষ্মকালীন দলবদলে মিলানকে ৭৩ মিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন চেলসির সভাপতি রোমান আব্রাহমোভিচ শেভচেঙ্কোকে দলে ভেড়াতে। তবে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল মিলান। তবে শেভচেঙ্কোর ইংল্যান্ড গমন ঠেকাতে পারেনি মিলান। প্রায় ৪৩ মিলিয়ন ইউরোতে তাঁকে পরের মৌসুমেই দলে নিয়ে আসেন চেলসি বস। রেকর্ড পরিমাণ অর্থ খরচ।

তবে ইংল্যান্ডে তাঁর জীবনটায় আবার হানা দেয় ইনজুরি। ২০০৬-০৭ মৌসুমে মাত্র ১৪টি গোল করেন শেভচেঙ্কো। হারমিয়া অপারেশন ও ইনজুরি তাঁকে নিজের সেই গোল মেশিন ফর্মে আর ফিরতে দেয়নি। ২০০৭-০৮ মৌসুমটাও কাটে ইনজুরিতে। সেবার মাত্র ২৫টি ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেন তিনি। বোঝায় পরিণত হয়ে যান চেলসির। লোনে চলে যান মিলানে। সেখানে এক মৌসুম কাটান। তবে খুব যে ভাল কেটেছে তা বলার অবকাশ নেই। মাত্র দুইটি গোল এসেছিল তাঁর পা থেকে।

অগত্যা তিনি আবার ফিরে যান তাঁর সাবেক ক্লাব ডায়নামো কিয়েভে। তিন মৌসুম খেলেন সেই ক্লাবটির হয়ে। ক্লাবের হয় উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাওয়া শেভচেঙ্কো জাতীয় দলে প্রথম সুযোগ পেয়েছিলেন ১৯৯৫ সালে। এরপর টানা ২০১২ পর্যন্ত তিনি ইউক্রেন জাতীয় ফুটবল দলের জার্সি গায়ে জড়িয়েছেন। সেই জার্সি পরে তিনি মোট ১১১ বার নেমেছিলেন মাঠে। করেছেন ৪৮ গোল। দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে নেমেই নিয়ে যান কোয়াটার ফাইনাল অবধি।

তাছাড়া ২০১২ সালে উয়েফা ইউরোতেও জাতীয় দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন শেভচেঙ্কো। ক্লাব জীবন তিনি সুসজ্জিত করেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে শুরু করে সিরি ‘এ’ এফ এ কাপ সহ শিরোপার বৈচিত্র্য দিয়ে। ইতালিয়ান লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়া ছাড়াও তিনি ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ সম্মাননা ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন ২০০৪ সালে।

২০১২ সালে শেভচেঙ্কো বিদায় জানিয়েছিলেন ফুটবল ক্যারিয়ারকে। হতে চেয়েছিলেন ফুটবল প্রশিক্ষক। তবে মতে পরিবর্তন। ফিরে যান স্বদেশে। অংশ নেন রাজনীতিতে। জাতীয় নির্বাচনেও লড়েন তিনি। তবে ফলাফল তাঁর বিপরীতে গেলে তিনি আর সেদিকে কালক্ষেপন করেননি। ২০১৬ সালে ইউক্রেন জাতীয় ফুটবল দলের সহকারী কোচের দায়িত্ব শুরু করেন। সে বছর জাতীয় দলের প্রধান কোচে দায়িত্ব পেয়ে যান শেভচেঙ্কো।

২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেন ইউক্রেন ফুটবলের উজ্জ্বল তারকা। সফলতাও পেতে থাকেন। তবুও নতুন অভিজ্ঞতার সন্ধানে ইতালির ক্লাব জেনোয়ার কোচ হন। তবে সেখানের ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ হলে তাঁকে তাঁর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় ক্লাবটি। এখন তিনি সন্ধানে রয়েছে নতুন কোন দায়িত্বের।

হয়ত অচিরেই ৪৫ বছর বয়সী সাবেক এই তারকা এই ফুটবলার খুঁজে পাবেন নতুন কোন দায়িত্ব। তবে তাঁর মনের ভেতর চলতে থাকা ঝড় তুফান কবে থামবে তা বলা দুষ্কর। তবুও সব অস্থিরতার অবসান হোক। বিতর্ক ও অশান্তির উর্ধ্বে গিয়ে এই পৃথিবী হোক প্রশান্তি আর ফুটবলের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link