আর্চি শিলারের কথা মনে আছে?
সেই যে অস্ট্রেলিয়া দলের এক দিনের অধিনায়ক। সেই যে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে বক্সিং ডে টেস্টে টস করতে নামা আর্চি!
ভুলে যাওয়া অসম্ভব নয়। তবে একটু পেছনে উকি দিলেই দেখবেন, আর্চির সেই অসাধারণ গল্পটা মনে পড়ছে। আর্চির গল্পটা তো কেবল একটা গল্প না। সে যেনো এক রূপকথার কাহিনী। ঘাতক রোগে ভুগতে থাকা আর্চির শেষ ইচ্ছে ছিলো অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কত্ব করা। দুই বছর আগের বক্সিং ডে টেস্টে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছিলো।
সে সময়ের ৮ বছর বয়সী আর্চি এখন কেমন আছে?
মাঝে অনেক গুজব রটেছিলো যে, আর্চি মারা গেছে। না, এমন খারাপ কিছু ঘটেনি। আর্চি এখনও লড়াই করে যাচ্ছে। সে দিব্যি কথা বলে, খেলে। এই তো বক্সিং ডে চলা অবস্থায় অস্ট্রেলিয়ার একটা টেলিভিশনে সাক্ষাতকার দিয়ে স্মৃতিচারণ করলো সে।
আচ্ছা, আর্চির এখনকার গল্প শোনার আগে বরং শুরু থেকে ঘটনাটা মনে করে আসা যাক।
এই ঘটনাটা ঘটিয়েছিলো মেক-উইশ ফাউন্ডেশন নামে একটা প্রতিষ্ঠান। অস্ট্রেলিয়ার একটি অন্যরকম স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা। তাঁদের উদ্দেশ্য বেশ অন্যরকম ও অনুকরণীয়।
সংস্থাটির উদ্দেশ্য হলো, ১৮ বছরের কমে যেসব কিশোর, বাচ্চারা কোন রোগে বা দুর্ঘটনায় মৃত্যুঝুঁকিতে আছে, তাঁদের একটি লৌকিক উদ্দেশ্য পূর্ণ করে তাঁরা। এ যেন আলাদীনের সেই চেরাগ নতুন করে জন্ম নিয়েছে দুর্ভাগা শিশুগুলোকে একটু খুশীর সুবাস দিতে।
তাঁদের এই প্রজেক্টে তেমনি একটি বাচ্চা ছিল আর্চি শিলার। ৮ বছরের বাচ্চাটা বিরল হার্টের রোগে ভুগছে; নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয়। বেশ ক বার অপারেশন হয়েছে। পূর্ণ সুস্থতা বহুদূর, ডাক্তাররা মৃত্যুঝুঁকিই এখনো ফেলে দিতে পারেন নি।
আর্চিকে পাওয়ার পর ফাউন্ডেশন তার কাছে জানতে চাইলো, তার ইচ্ছেটা কী। আর্চির প্রথম ইচ্ছা ছিল, বাবা-মাকে ঈশ্বররূপে দেখার। কি পবিত্র চিন্তা! কিন্তু ইহলোকে এই ইচ্ছেপূরন যেহেতু সম্ভব না, বুঝিয়েসুঝিয়ে তার কাছে দ্বিতীয় ইচ্ছা জানতে চাওয়া হয়।
আর্চির পরের ইচ্ছেটা আসলে প্রতিটি অস্ট্রেলিয়ান শিশুই বোধহয় বুকে লালন করে সেই ছোট থেকে; অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব করা।
কঠিন, খুব কঠিন এই স্বপ্নপূরণ। কিন্তু অসম্ভব তো নয়। মেক-এ-উইশ কাজে লেগে পড়ে। অস্ট্রেলিয়ান বোর্ড থেকে শুরু করে প্লেয়াররা এইরকম কাজকে সাধুবাদ জানায়। দারুন সাড়া পায় ফাউন্ডেশন ও আর্চির ইচ্ছে।
কোচ, প্লেয়ারদের অনুরোধ, ফাউন্ডেশনের প্রচেষ্টায় লিগ্যাল পারমিশনও মিলে যায়। অবশেষে বক্সিং ডে টেস্টকে বেছে নেওয়া হয় আর্চির স্বপ্নপূরণের জন্য।
২০১৮ এর বক্সিং ডে টেস্টে বিরাট কোহলির বিপক্ষে টিম পেইনের সাথে কো-অধিনায়ক হিসেবে টস করতে নামে আর্চি। এর আগে কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গারের হাতেই মাথায় চড়ে ব্যাগি গ্রিন। টসের পর অনুশীলনেও অংশগ্রহণ করে আর্চি।
আর্চি স্বপ্ন দেখে বোলিং করে কোহলির উইকেট নেবার। কোহলিকে বল করার সুযোগও পেয়েছিল সে। আর্চি ২০১৯ বিশ্বকাপে দলকে জয়ী করার ছকও কষে ফেলেছিল অজি ড্রেসিংরুমে বসে।
মানবতার সেই জয়ের দিনের দুই বছর কেটে গেছে। এই ক দিন আগে আরেকটি বক্সিং ডে টেস্টে খেলেও ফেলেছে অস্ট্রেলিয়া ও ভারত। সে উপলক্ষ ও মেক-এ-উইশ ফাউন্ডেশনের ৩৫তম বর্ষপূর্তিতে স্মরণ করা হয় প্রথম অজি ‘কো-অধিনায়ক’ ক্যাপ্টেন আর্চিকে।
সেদিনের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছিল আর্চি। বেশ ফর্মালভাবেই ড্রেসিংরুমে তাঁকে আমন্ত্রণ করেন কোচ জাস্টিন, ছেলেটার স্বপ্নপূর্ণে নিজেও মন থেকে সামিল হয়েছিলেন বোঝা যায়। টসে বিরাট কোহলি অভিবাদন জানান। মাঠে নেমে ফিল্ডিংয়ের অভিজ্ঞতাও ছিল আর্চির। তবে আর্চির সবচেয়ে ভাল লেগেছিল, ড্রেসিংরুমের পরিবেশ। সবার হাসিঠাট্টা, মজা এরমধ্যেই ক্রিকেট, সবাই বন্ধু হয়ে গিয়েছিল ওর, এই অসাধারণ জায়গাটার সদস্য হতে চায় আর্চি।
আন্তরিকতার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে স্মৃতিচারণের সেই কলে যুক্ত হয়েছিলেন নাথান লায়ন। ছোট্ট অধিনায়কের সাথে অনেক কথাই বললেন। জেনে নিলেন কোহলিকে আউট করবার তরিকা! ক্যাপ্টেন আর্চি বোদ্ধাদের মতই গম্ভীরভাবে তাঁকে পরামর্শ দিল, ভয় না পেয়ে নিজের মত বোলিং করতে!
কে জানে, আর্চি হয়তো এই লড়াইটা জিতেও যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে লায়নদের চেয়ে তার অভিজ্ঞতাটা তো একেবারে কম হবে না। ৮ বছর বয়সেই যে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কত্ব করে ফেলেছে। এখন সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে মাঠেই চলে আসুক আর্চি।
আর্চিরা আশা ছাড়েনা। তাঁকে যে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক হতেই হবে, এই জোরের কাছে রোগ যে তুচ্ছ।