বাছাইপর্বে রীতিমত দাপট। সবাইকে তুচ্ছ প্রমাণ করে পয়েন্ট তালিকার শীর্ষস্থান দখল। চমক দেখানো পারফরমেন্স আর ধারাবাহিকতা নিয়ে আর্জেন্টিনা পা রেখেছিল জাপান-কোরিয়ায়, ২০০২ ফুটবল বিশ্বকাপ খেলতে। সবাই হয়ত ধরেই নিয়েছিল আর্জেন্টিনাই সেবার নিয়ে যাবে বিশ্বকাপ। তবু কোথাও একটা যেন খেই হারিয়ে ফেলেছিল দলটি। কেমন যেন হিসেব-নিকেশ ওলট-পালট হয়ে যায়।
বিশ্বকাপের বাছাইয়ের লাতিন পর্বে মাত্র একটি ম্যাচ হেরেছিল আলবেসেলেস্তারা। ১৮টি ম্যাচের চারটিতে ড্র করেছিল হুয়ান সেবাস্টিয়ান ভেরনের সতীর্থরা। একচ্ছত্র আধিপত্য। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইকুয়েডরের সাথে পয়েন্টের ব্যবধান ছিল ১২ পয়েন্টে। দৃষ্টান্তমূলক ব্যবধানে ২০০২ সালের বিশ্বকাপের টিকিট কেটেছিল আর্জেন্টিনা। সমর্থকেরা নিশ্চিতভাবেই ভেবে রেখেছিল ১৯৮৬ এর পর আবার সেই স্বর্ণালী শিরোপা।
সেই ভেবেই মার্সেলো বিয়েলসা তাঁর শীর্ষ্যদের নিয়ে এসেছিলেন এশিয়া মহাদেশে। ফুটবল বিশ্বে বেশ সমাদৃত এই কোচ পরবর্তীতে তাঁর দেশের মানুষদের চোক্ষুশূল হয়েছিলেন। অথচ তাঁকে মাউরিসিও পচেত্তিনো মানেন নিজের ফুটবল জ্ঞানের পিতা হিসেবে। অন্যদিকে ফুটবল বিশ্বের অন্যতম সফল কোচ পেপ গার্দিওলা তাঁকে আখ্যায়িত করেছেন সেরা কোচ হিসেবে। তবুও ওই এক বিশ্বকাপ তাঁকে স্বদেশের সামনে উপস্থাপন করেছিল খলনায়ক হিসেবে।
বাছাই পর্বে দাপট দেখিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া আর্জেন্টিনা সেবার বাদ হয়ে গিয়েছিল গ্রুপ পর্ব থেকেই। সেবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় অঘটন বোধ হয় সেটাই ছিল। বাছাই পর্বে গুণে গুণে ৪২ খানা গোল। আবার সেই আক্রমণভাগ গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচে মাত্র দুই গোল করতে পেরেছিল। প্রথম ম্যাচে ১-০ গোলের কষ্টার্জিত জয় ও সুইডেনের সাথে ১-১ গোলের ড্র এই দুই গোল দেওয়ার বৃত্তান্ত।
সুইডেনের বিপক্ষে এক গোল হজম করার পাশপাশি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১-০ গোলের হার। মোট মিলিয়ে মাত্র চার পয়েন্ট নিতে পেরেছিল বিয়েলসার শীর্ষ্যরা। তবে তাতে কাজ হয়নি। ইংল্যান্ড ও সুইডেন সমান পাঁচ পয়েন্ট নিয়ে চলে গিয়েছিল পরের রাউন্ডে। সবার যেন মাথায় হাত। এ কি! গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ আর্জেন্টিনা। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।
সেই দলটা যে ধারাবাহিক পারফরমেন্সের মধ্যেই ছিল তা নয়। সে দলটায় বিশ্বমানের খেলোয়াড়দের আধিক্য ছিল চোখ পড়ার মত। এত প্রতিভাবান খেলোয়াড় থাকার পরও হারতে হয়েছিল। সে সময় আর্জেন্টিনা দলে থাকা প্রত্যেক খেলোয়াড় নিজ নিজ জায়গায় ছিল বিশ্বমানের। তবুও কেন এমন হোঁচট? সে প্রশ্নের জবাবে প্রথম সোজাসাপ্টা একটা উত্তর দিয়ে দেওয়া যায়। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস।
যেহেতু বিশ্বকাপের আগে ভাল একটা সময় পার করছিল আর্জেন্টিনা। টানা জয়, গোল বন্যা এসব কিছু হয়ত বাড়তি আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেটাই হয়ত কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাছাড়া বিয়েলসার যে একেবারেই কোন দোষ ছিল না সেটাও মানতে নারাজ বেশকিছু সমালোচক। কেননা তিনি মাঠে ঠিক একটা দল নামাতে পারেননি। তিনি আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে গিয়ে দলের ফরমেশনে খানিক গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেলেছিলেন।
আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের খেলার ধরণে বেশ অপ্রস্তুত এক ভাব ছিল। তাঁরা যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না কি করতে হবে। এমন এক দোটানা মোটামুটি পুরো দলেই বিরাজ করছিল। এছাড়াও আরও বেশ বড় একটা কারণ ছিল বেশ কিছু খেলোয়াড়ের ইনজুরি। সে তালিকায় অধিনায়ক রবার্তো আয়ালা যেমন ছিলেন ঠিক তেমনি ভেরন, ক্লডিও ক্যানিজিয়ারাও ছিলেন।
ইনজুরি ছাড়াও স্রেফ ভাগ্যের দোষ দিয়েও উড়িয়ে দেওয়া যায়। তবে আদোতে সেই অঘটনের একটা যথার্থ কারণ খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। বিশ্বকাপের মঞ্চের একটা আলাদা চাপ থাকে সে চাপটা স্নায়ুতে বেশ প্রভাব ফেলে। বিশ্বজয়ী যারা তাঁরা সবাই সেই স্নায়ুচাপ, প্রত্যাশার চাপ সবকিছু সামলে নিয়ে দিনগুলো নিজেদের করে নেন। হয়ত সেবার আর্জেন্টিনা পারেনি।