আর্জেন্টিনার সুযোগ, মেসির শেষ সুযোগ

১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ কিংবা ১৯৯৩ সালে কোপা আমেরিকা জেতার পর প্রায় ২৭ বছর শিরোপাহীন থাকতে হয়েছে আর্জেন্টিনাকে। গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, পাবলো আইমার, হুয়ান রিকুয়েলমের মতো তারকারা উঠে আসলেও ট্রফির দেখা মেলেনি। এমনকি লিওনেল মেসিকেও হাতছোঁয়া দূরত্বে থেকে ফিরতে হয়েছে তিনবার। অবশেষে দুই লিওনেল – স্কালোনি এবং মেসির যুগলবন্দীতে শিরোপা খরা কাটিয়েছে আলবিসেলেস্তেরা, চিরপ্রতিদ্বন্দী ব্রাজিলকে হারিয়ে জিতেছে কোপা আমেরিকার বিজয়ীর মুকুট। দু:স্বপ্ন কাটিয়ে আর্জেন্টিনা এবার তাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কাতার বিশ্বকাপের শিরোপাটাও নিজের করে নিতে।

অথচ লিওনেল স্কালোনির আর্জেন্টিনার কোচ হওয়ারই কথা ছিল না। এদুগার্দো বাউজা এবং হোর্হে সাম্পাওলিকে বরখাস্ত করার পর অর্থসংকটে ভোগা আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশন একপ্রকার বাধ্য হয়েই নিয়োগ দেয় স্কালোনিকে। তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন স্কালোনি ব্যর্থ হবেন এবং আর্থিক সমস্যা কিছুটা কাটিয়ে উঠা গেলেই তাঁরা নিয়োগ দেবেন হাইপ্রোফাইল কোনো কোচকে। কিন্তু সেই সুযোগ দেননি স্কালোনি, দায়িত্বের প্রথম দিন থেকেই নিজের সেরাটা ঢেলে দিয়েছেন।

ইউরোপের আনাচে কানাচে থেকে তুলে এনেছেন তরুণ প্রতিভা, দলের উন্নতির জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেও দুবার ভাবেননি। যার ফলাফল ২০২১ সালে আর্জেন্টিনার কোপা আমেরিকা এবং ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে উড়িয়ে দিয়ে ফাইনালিসিমা জেতা। টানা ৩৫ ম্যাচে অপরাজিত থাকার সুখস্মৃতি সঙ্গে করেই এবারের বিশ্বকাপ খেলতে আসছে স্কালোনির দল। 

গত কয়েকটি বৈশ্বিক আসরে আর্জেন্টিনার মূল সমস্যা ছিল গোলরক্ষক এবং রক্ষণভাগকে ঘিরে। বিশেষ করে রক্ষণে হাভিয়ের মাসচেরানো এবং কিপিং এ সার্জিও রোমেরোর অনুপস্থিতি পুরণ করতে পারছিলেন না কেউই। ২০১৮ বিশ্বকাপে গোলের নিচে ফ্রাংকো আরমানির পারফরম্যান্স রীতিমতো হাস্যরসে পরিণত হয়েছিল। তবে চার বছরের ব্যবধানে বদলে গেছে দৃশ্যপট, গোলকিপার এবং রক্ষণভাগ এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার অন্যতম শক্তির জায়গা। গোলবারের নিচে এমিলিয়ানো মার্টিনেজের উত্থানটা তো চোখে পড়ার মতো।

টানা দশ বছর বসে ছিলেন আর্সেনালের বেঞ্চে, মাঝে লোনে গিয়েছিলেন নিচের সারির ক্লাবগুলোতে। বানার্ড লেনোর ইনজুরিতে মাঝমৌসুমে সুযোগ পেয়ে খুলে যায় তাঁর ভাগ্য। অনবদ্য পারফর্ম করে জানান দেন নিজের সামর্থ্যের, জাতীয় দলের পাশাপাশি পরের মৌসুমেই তাঁকে দলে ভেড়ায় অ্যাস্টন ভিলা। কোপা আমেরিকাতে সেমিতে টাইব্রেকারে কলম্বিয়ার বিপক্ষে তিনটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে আর্জেন্টিনার জয়ের নায়ক তিনি। 

রক্ষণভাগেও উন্নতিটা চোখে পড়বার মতো। পুরনো সেনানী নিকোলাস ওটামেন্ডির সাথে জুটি বাঁধবেন টটেনহ্যামের ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো। এছাড়া বেঞ্চে থাকবেন লিসান্দ্রো মার্টিনেজ, জার্মান পেজ্জেলা, মার্কাস সেনেসির মতো সেন্টারব্যাকরা। ফুলব্যাক পজিশনেও স্কালোনি পেয়েছেন ভরসার পাত্রদের। হুয়ান ফয়েথ, মার্কাস আকুনা, গঞ্জালো মন্টিয়েল কিংবা নাহুয়েল মলিনারা নিজেদের পজিশনে বিশ্বসেরা না হলেও পরিশ্রম করতে জানেন, হার না মানা মানসিকতা নিয়ে লড়াই করে যান শেষ মিনিট পর্যন্ত।

আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডও বেশ ভারসাম্যপূর্ণ। বিশ্বসেরা সব মিডফিল্ডারের উপস্থিতি না থাকলেও, যারা আছেন তাঁরা সবাই একে অন্যের পরিপূরক। পারেদেস, রদ্রিগো ডি পল, প্যালাসিওস, এনজো ফার্নান্দেজ, জিওভান্নি লো সেলসো, গুইদো রদ্রিগেজ, পাপু গোমেজরা নিজেদের ক্লাবের সেরা তারকা না হলেও জাতীয় দলের প্রশ্নে তাঁদের আত্ননিবেদন প্রশ্নাতীত।

কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁরা লড়াই করে যান নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে। অন্যদিকে আর্জেন্টিনার আক্রমণভাগ বরাবরই বিশ্বসেরা। অভিজ্ঞ লিওনেল মেসি, ডি মারিয়ার সাথে রয়েছেন লাওতারো মার্টিনেজ, জুলিয়ান আলভারেজ, অ্যাঞ্জেল কোরেয়া, নিকো গঞ্জালেসদের মতো তরুণ প্রতিভারা। নিজেদের দিনে বিশ্বের সেরা রক্ষণভাগের ভীত কাঁপিয়ে দেয়ার সামর্থ্য আছে এই দলের আক্রমণভাগের। 

তবে লিওনেল স্কালোনির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব বোধহয় মেসি নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসা। আর্জেন্টিনা এখনো অনেকটাই মেসিকে কেন্দ্র করে আক্রমণ সাজায়, কিন্তু আগের মতো পুরো দায়িত্বটা তাঁর উপর চাপিয়ে দেয় না। বরং খেলোয়াড়দের মাঝে বাড়তি তাগিদ দেখা যায় মেসির উপর থেকে চাপটা কমানোর। গত বছর দুয়েকে ব্যক্তিগত নয় বরং দলগত ফুটবলশৈলীতে আর্জেন্টিনা মুগ্ধ করেছে বিশ্ববাসীকে। এছাড়া স্কালোনির আরেকটা ভালো ব্যাপার হলো তিনি দল সাজানো নিয়ে অনেক ফ্লেক্সিবল। মুখস্ত একাদশ না খেলিয়ে বরং প্রতিপক্ষ বিবেচনায় দলের দর্শন ঠিক করেন। 

এবারের বিশ্বকাপে মেসির পাশাপাশি আর্জেন্টিনার জন্য এক্স ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন ইন্টারমিলানের স্ট্রাইকার লাওটারো মার্টিনেজ। ইউরোপে পা রাখার পর থেকেই নিয়মিত গোল করে যাচ্ছেন এই স্ট্রাইকার। ইন্টারকে সিরি আ’র শিরোপা জিতিয়েছেন, তাঁকে কেন্দ্র করেই আক্রমণভাগ সাজায় মিলানের দলটি। জাতীয় দলেও সমান সফল এই স্ট্রাইকার, সর্বশেষ কোপা আমেরিকায় নক আউট পর্বে গোল ছিল এই স্ট্রাইকারের। এবারের বিশ্বকাপেও গোলের জন্য মার্টিনেজের দিকে তাকিয়ে থাকবেন আর্জেন্টাইন সমর্থকরা। 

তবে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার নাম ইনজুরি। এমনিতেই লিগের মাঝপথে বিশ্বকাপ হওয়ায় টানা ম্যাচ খেলার ক্লান্তি তো থেকেই যায়। এছাড়াও শুরুর আগেই ইনজুরিতে পড়েছেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া, পাওলো ডিবালা, জিওভান্নি লো সেলসো, নিকো গঞ্জালেসরা। ইনজুরির কারণে হেরে যাওয়া তিন ফাইনালের একটিতেও শুরুর একাদশে ছিলেন না অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। একটি মাত্র ফাইনালে একাদশে ছিলেন তিনি, আর সেটাতেই বাজিমাত।

ফাইনালে একমাত্র গোল করে দলকে শিরোপা এনে দিয়েছেন তিনিই। আর্জেন্টাইন ভক্ত সমর্থকদের দৃঢ় বিশ্বাস আগের ফাইনালগুলোতেও তিনি থাকলে ম্যাচের ফলাফল ভিন্ন হতে পারতো। ইনজুরিতে থাকলেও বিশ্বকাপ শুরুর আগেই সেরে উঠার কথা এই উইংগারের। একই কথা খাটে পাওলো ডিবালার ক্ষেত্রেও, গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচ থেকেই পাওয়া যাবার কথা এ দুজনকে। তবে জিওভান্নি লো সেলসোর ক্ষেত্রে এতটা আশাবাদী হতে পারছেন না আর্জেন্টাইন কোচ কিংবা ফিজিও, অভূতপূর্ব কিছু না ঘটলে বিশ্বকাপ মিস করতে যাচ্ছেন এই মিডফিল্ডার। আর সেটা ঘটলে স্কালোনি এবং আর্জেন্টিনার জন্য হবে বিশাল ক্ষতি। কোচ অবশ্য জানিয়ে রেখেছেন লো সেলসোর জন্য শেষমূহুর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন তাঁরা। টুর্নামেন্টের মাঝপথের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাই ইনজুরি বড় এক বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে আলবিসেলেস্তেদের জন্য। 

২২ নভেম্বর সৌদি আরবের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করবেন মেসি-ডি মারিয়ারা। মেক্সিকো এবং পোল্যান্ডের গ্রুপ থেকে নক আউটে উঠা খুব একটা কঠিন হবার কথা নয় তাঁদের জন্য। তবে শেষ চারে দেখা হয়ে যেতে পারে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের সাথে, কোপার ফাইনালের প্রতিশোধ নিতে সেদিন মুখিয়ে থাকবেন নেইমাররা। তবে আর্জেন্টিনা সেই চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত, নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ তাঁরা দিয়েছেন আগেই। এখন দেখার বিষয় বিশ্বকাপের মঞ্চে আরো একবার দিয়েগো ম্যারাডোনার কীর্তির পুনঃমঞ্চায়ন করতে পারেন কিনা আর্জেন্টাইন ফুটবলাররা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link