বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পূর্ববর্তী যুগে সেরা টেস্ট ব্যাটার কে ছিলেন?
প্রশ্নটা অবান্তর। তবে উত্তরটা হলো- মিনহাজুল আবেদিন নান্নু। টেস্ট ক্রিকেটে দারুণ কিছু করবেন এমন সম্ভাবনা থাকা স্বত্ত্বেও ক্যারিয়ারে কখনোই টেস্ট খেলা হয় নি নান্নুর। কারণ বাংলাদেশ যখন প্রথম টেস্ট খেলেছে তার বছর দেড়েক আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।
আমাদের এ প্রজন্ম মিনহাজুল আবেদিন নান্নুকে চেনে বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রধান নির্বাচক হিসেবে। দল নির্বাচন আর বিতর্ক, সব সময়ই এ দুই শব্দকে সমার্থক রূপে সঙ্গী করে বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। কিন্তু অনেকেই নির্বাচক নান্নুর সাথে তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারও গুবলেট পাকিয়ে ফেলেন। নির্বাচক হিসেবে ব্যর্থতার সাথে মিলিয়ে সমালোচনা করে বসেন তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়েও।
২৭ ওয়ানডেতে ১৮.৮৭ গড়ের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের একজন কিভাবে নির্বাচক হয়, এমন ক্লিশে প্রশ্নও করে ফেলেন অনেকে। ভাবনায় আনেন না, নান্নুরা যে সময় ক্রিকেট খেলেছেন তখন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচই খেলতো কম। বছরে ১/২ টা ম্যাচেই আটকে থাকতো তাঁরা। তাই ১৩ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে দলের নিয়মিত ক্রিকেটার হয়েও মিনহাজুল আবেদিন নান্নু ম্যাচ খেলেছেন মাত্র ২৭ টা।
দীর্ঘ বিরতির পর পর এমন করে ১/২ টা ম্যাচ খেললে আদৌতে কোনো দেশের ক্রিকেটারেরই পরিসংখ্যান উজ্জ্বল হত না। মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। অনেকের মতে নব্বই দশকে বাংলাদেশের সেরা এ ব্যাটার তাই একারণেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সফল হতে পারেননি।
১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ প্রথম বারের মত বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলার সুযোগ পায়। বাছাইপর্বে কেনিয়াকে ফাইনালে হারিয়ে সেবারের বিশ্বকাপ খেলার পথে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছিল আইসিসি ট্রফি। সেই আইসিসি ট্রফির সব আসর মিলিয়ে বাংলাদেশের সেরা পারফর্মার ছিলেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নু। ৭৬১ রানের পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছিলেন ৩৯ উইকেট। মূল পরিচয় ব্যাটার হলেও, আইসিসি ট্রফিতে সবচেয়ে সফলতম বোলারের নামটা মিনহাজুল আবেদিন নান্নু।
১৯৯৯ আইসিসি ট্রফি মিশন শেষ। চ্যাম্পিয়ন হয়ে বীরের বেশে বাংলাদেশ দলের দেশে প্রত্যাবর্তন। সাথে সে বছরেই সবার চোখেমুখে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নের ঝিলিক। বিশ্বকাপের মঞ্চে পদচ্ছাপের স্বপ্নে আবিষ্ট হওয়া ক্রিকেটারদের মধ্যে ছিলেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নুও।
কিন্তু, বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় নির্বাচনী বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম। বিশ্বকাপের জন্য ৩০ দলের স্কোয়াডটা যখন ১৯ এ নেমে এল, তখন দেখা গেল সেই তালিকায় নান্নু নামটা নেই। অথচ দল ঘোষণার ৩ দিন আগেই এক প্রস্তুতি ম্যাচে সেঞ্চুরি করলেন। প্রিমিয়ার লিগেও করেছেন ২ সেঞ্চুরি। তারপরও বিশ্বকাপের চূড়ান্ত স্কোয়াডে নান্নুর না থাকার কারণ কী?
নির্বাচকের ভাষ্য অনুযায়ী, পারফরম্যান্সের কারণে বাদ পড়েননি নান্নু। বাদ পড়েছেন শৃঙ্ক্ষলাজনিত কারণে। অথচ নান্নু পুরোদস্তুর টিমম্যান হিসেবেই পরিচিত। তাই নির্বাচকের কথায় মন ভরলো না কারোরই। এরপরই শুরু হয় তোলপার। সারাদেশে নান্নুকে দলে না নেওয়ার প্রতিবাদে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে বিসিবি সেই সিলেকশন কমিটি ভেঙে দিতে বাধ্য হয়।
নতুন করে ঘোষণা করা হয় বিশ্বকাপের স্কোয়াড। শেষ পর্যন্ত, সে স্কোয়াডে সুযোগ হয় নান্নুর। তবে প্রশ্ন উঠেছিল, শৃঙ্খলাজনিত কী এমন কারণ ছিল যে নান্নুকে বাদ দিতে হয়েছিল? পরবর্তীতে জানা যায়, নান্নুকে বাদ দেওয়ার পিছনে শৃঙ্খলার কোনো ইস্যুই ছিল না। মূলত তখনকার সময়ে ঢাকার লিগ ক্রিকেট খুব জমজমাট ছিল। তখন মোহামেডান, আবাহনী, দুই দলেরই ক্রিকেটে খুব প্রভাব ছিল। কিন্তু আগের মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে নান্নু খেলেছিলেন সূর্যতরুণের হয়ে। আর এ কারণেই প্রথম ঘোষিত বিশ্বকাপ স্কোয়াড থেকে তিনি বাদ পড়েছিলেন।
এরপর ১৯৯৯ বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ ছিল নিউজিল্যান্ডের সাথে। সেই ম্যাচে দলেই জায়গা হলো না নান্নুর। ড্রেসিংরুমে বসে দেখলেন দলের হার। দ্বিতীয় ম্যাচে ফিরলেন মোহাম্মদ রফিকের জায়গায়। কিন্তু ব্যর্থ হলেন মোটাদাগে, করলেন মাত্র ৫ রান। তবে ফর্মে ফিরলেন একেবারে মোক্ষম সময়ে; স্কটল্যান্ডের সাথে যখন ২৬ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে বাংলাদেশ।
সেই অবস্থায় নাইমুর রহমান দুর্জয়ের সাথে গড়লেন ৭১ রানের পার্টনারশিপ। দলকে ৯৬ রানে রেখে দুর্জয় আউট হলেও তিনি থেকে গেলেন শেষপর্যন্ত, অপরাজিত ৬৮ রান করে দলকে নিয়ে গেলেন ১৮৫ রানের মান বাঁচানো সংগ্রহে। ৬৮ রান খুব আহামরি কিছু না। একটা হাফসেঞ্চুরিই মাত্র। কিন্তু ম্যাচের পরিস্থিতিতে সেই ৬৮ রানই ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ইনিংস।
১৮৬ রানের টার্গেটে স্কটল্যান্ড খারাপ খেলছিল না। যদিও এক সময় ৮৩ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলে তারা। তবে গ্যাভিন হ্যামিল্টন নামের এক বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান স্কটল্যান্ডকে নিয়ে যাচ্ছিলেন জয়ের দিকে। কিন্তু ১৩৮ রানে এক দুর্ভাগ্যজনক রানআউটের পর আর পেরে ওঠেনি স্কটল্যান্ড। অলআউট হয় ১৬৩ তে। বাংলাদেশ ম্যাচটি জিতে নেয় ২২ রানে।
৬৮ রানের পরে বোলিংয়ে সেদিন এক উইকেট নিয়েছিলেন নান্নু। একই সাথে হয়েছিলেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ। যাকে স্কোয়াডেই নেয়া হচ্ছিলো না সেই খেলোয়াড়টিই হয়ে গেলো বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম জয়ের নায়ক।
পরের ম্যাচ অস্ট্রেলিয়ার সাথে। সেই ম্যাচেও নান্নুর ঝলকানি। করলেন ৫৩। অর্থাৎ ব্যাক টু ব্যাক হাফ সেঞ্চুরি। যদিও দিনশেষে ম্যাচটি হেরে যায় বাংলাদেশ। সে বারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ তাদের শেষ ম্যাচটি খেলেছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে। এ ম্যাচের কথা নিশ্চয় আলাদা করে বলতে হবে না।
বিশ্বকাপের মঞ্চে এসে পাকিস্তানকে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। ম্যাচজয়ের পরে গ্যালারি থেকে নেমে আসা উচ্ছ্বসিত দর্শকের সে দৃশ্য এখনো তাজা মনে হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, গ্যালারি থেকে নেমে আসা দর্শকের ভীড়ে সেদিন নিজের ক্যাপ হারিয়ে ফেলেছিলেন নান্নু। অবশ্য এক দিক দিয়ে চিরতরেই সে ক্যাপটা হারিয়ে ফেলেন নান্নু। কারণ ঐ ম্যাচটিই হয়ে যায় তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। কোচ গর্ডন গ্রিনিজের বিদায়ের দিনে তাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যবনিকাপাত ঘটে খেলোয়াড়ও নান্নুরও।
মিনহাজুল আবেদীন নান্নু কিভাবে দেশসেরা টেস্ট ব্যাটার হতে পারতেন, সেই ব্যাখ্যাটা দিয়ে শেষ করি। নান্নু টেস্ট ক্রিকেট খেলেননি কিন্তু প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছেন ২৪ টি। সেই ২৪ ম্যাচে নান্নুর পরিসংখ্যান কী জানেন? ৩৬ ইনিংসে ৪ সেঞ্চুরি আর ৯ হাফসেঞ্চুরিতে ১৭০৯ রান, গড় ৫১.৭৮!
আশির দশকে ক্রিকেট শুরু করা এক বাংলাদেশি ব্যাটারের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট গড় ৫১.৭৮। তাহলে ভাবুন, তাকে নিয়ে তোলপাড় হবে না কেন? কেনই বা টেস্ট ক্রিকেটে নান্নুকে না দেখতে পারার আক্ষেপে পুড়বে না সে সময়ের সমর্থকরা?