চির অপরাজিত

‘আমরা সুপারস্টার কিনি না, বানাই’

– আর্সেন ওয়েঙ্গার

ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা ফিফা বিশ্ব ফুটবলের যে দলটিকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাঁচটি ফুটবল দলের তালিকায় স্থান দিয়েছে তা প্রকৃত অর্থেই ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। ২০০৩-২০০৪ সালের সেই ঐতিহাসিক আর্সেনাল দল আজ বিশ্ব ফুটবলে ‘দ্য ইনভিন্সিবল’ বা ‘অপরাজেয়’।

২০০৩-২০০৪ মৌসুমে ক্লাবের গ্যালারি সংস্কারের জন্য সেভাবে খেলোয়াড় কিনতে পারেনি গানাররা। কিন্তু, কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারের ইচ্ছায় অধিনায়ক প্যাট্রিক ভিয়েরার সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করে ক্লাব৷ আর্সেন এই মৌসুমের শুরু থেকেই দলের খেলার ধরণের খোলনলচে বদলে দেওয়ার পরামর্শ দেন৷ সেই মতো গোলরক্ষক লেম্যান, দুই সেন্ট্রালব্যাক ক্যাম্পবেল ও তোরে, সাইডব্যাকে লরেন এবং আশলে কোলকে নিয়ে রক্ষণ মেরামতি সম্পূর্ণ করেন আর্সেনাল কোচ।

মাঝমাঠের গুরুদায়িত্ব আসে ক্যাপ্টেন ভিয়েরার কাঁধে, গিলবার্তো সিলভা ও রবার্ট পিরেসকে সাথে নিয়ে তিনি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ অভিযান শুরু করেন আর সামনে থাকেন দুই ধুরন্ধর স্ট্রাইকার বার্গক্যাম্প আর থিয়েরি অঁরি। প্রিমিয়ার লিগের প্রথম ম্যাচেই পিরেসের হ্যাটট্রিকে ভর করে ৬-১ গোলে সাউদ্যাম্পটনকে হারায় গানাররা। এই ম্যাচের পরই এক স্বপ্নের দৌড় শুরু করে আর্সেন ওয়েঙ্গারের ছেলেরা।

বার্গক্যাম্প-ভিয়েরা-পিরেসের দুরন্ত ফুটবল আর সাথে অঁরির ঐশ্বরিক গোল করার ক্ষমতার কাছে ক্রমশ ফিকে হয়ে যেতে থাকে বাকি দলগুলি। একে একে সান্ডারল্যান্ড, ম্যানচেস্টার সিটি, টটেনহ্যাম, চেলসিকে হারিয়ে লিগের মাঝপথেই প্রায় খেতাব পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখা শুরু করতে থাকে ভিয়েরা-বার্গক্যাম্পরা। প্রথম স্পেলে টানা ২৩ ম্যাচ অপরাজিত থেকে ইউরীপীয় ফুটবলে বিষ্ময় ঘটিয়ে দেয় এই দল।

দ্বিতীয় লেগে আরও ঝলসে ওঠেন অঁরি ও বার্গক্যাম্প। ভিয়েরার নিখুঁত পাসিংকে কাজে লাগিয়ে প্রিমিয়ার লিগে গোলের বন্যায় বাকি সব দলকে ভাসিয়ে ৩০ নম্বর ম্যাচের পরই কার্যত খেতাব নিশ্চিত হয়ে যায় আর্সেনালের। ২০০৪ সালে যখন আর্সেনাল লিগ শেষ করে তখন রেকর্ডবুকে উঠে গেছে অসংখ্য রেকর্ড; টানা ৩৮ ম্যাচ অপরাজিত থেকে লিগ জয়ের পর ‘দ্য ইনভিন্সিবল’ তকমা পায় তারা। এর আগে এই তকমা পেয়েছিল আরিগো সাকি-র এসি মিলান।

এই রেকর্ডের পর ব্রিটিশ ফুটবল সংস্থা প্রিমিয়ার লিগের সাথে প্রথমবার একটি সোনার খেতাব তুলে দেয় চাণক্য আর্সেন ওয়েঙ্গারের হাতে। ৫১ ম্যাচে ৩৯ গোল করে ওই মৌসুমে টানা তৃতীয়বারের জন্য সর্বোচ্চ গোলদাতা হল অঁরি। ১৯ গোল করে পিরেস হন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা। ওই মৌসুমে শ্রেষ্ঠ গোলের দাবিদার ও হন এই আর্সেনাল দলেরই দুই সুপারস্টার অধিনায়ক ভিয়েরা এবং অঁরি।

সমগ্র ইউরোপিয়ান ফুটবল সেদিন দেখেছিল বিশ্বফুটবলে আর্সেনালের একচ্ছত্র আধিপত্য। লিগজয়ের পরেও আ রও ১১টি ম্যাচ জিতে টানা ৪৯ ম্যাচ অপরাজিত থাকার বিশ্বরেকর্ড দখলে আনে আর্সেনাল। সে বছর ফিফার প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার, এফডব্লুএ’র ফুটবলার অফ দ্যা ইয়ার খেতাবও জিতে নেন ফরাসি তারকা অঁরি।

ফুটবলের ইতিহাসে ট্রফিজয় কিংবা দুরন্ত প্রতিভার নিদর্শন ফিরে এসেছে বারেবারে। কিন্তু ২০০৪ সালের আর্সেনাল ছিল দলগত সংহতির সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ডিফেন্স থেকে স্ট্রাইকিং লাইন সবেতেই আর্সেন ওয়েঙ্গার তাঁর দলে যে দলগত নৈপুণ্য প্রদর্শনের বীজ পুঁতে দিয়েছিলেন তা-ই মহীরুহ হয়েছিল মৌসুম শেষে- তাই তো আজও তারা ‘দ্য ইনভিন্সিবল’, চির অপরাজিত।

কে বলে লক্ষ্যের প্রতি স্থির বিশ্বাস ইতিহাস রচনা করে না?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link