৩৭.৭৬ গড়ে এক দিনের ক্রিকেটে ১৯৬৪ রান। বিশেষ কিছু নয়। ঐ ‘গড়পড়তা’ শব্দেই বড়জোর আটকে রাখা যায়। আজকালকার ক্রিকেটে এমন রান বছর দুয়েকের মধ্যেই করে ফেলেন অনেকে। রেকর্ডবুকের দলিল দস্তাবেজে তাই এমন পরিসংখ্যানওয়ালা ব্যাটার আছে ভুরি ভুরি। তবে ইতিহাস তো শুধু সমৃদ্ধময় ক্যারিয়ারকে পুঁজি করে এগোয় না। নিতান্তই গড়পড়তা এক ব্যাটারও হয়ে উঠতে পারেন স্মরণীয়। আশিষ বাগাই ঠিক তাদেরই দলের একজন।
না। ক্রিকেট পরাশক্তির কোনো দেশে তিনি জন্মাননি। ক্রিকেট মানচিত্রে একদম পিছন সারির এক দেশ কানাডাতে জন্ম। সেখানেই বেড়ে ওঠা। আর সেই কানাডার হয়েই ক্রিকেট খেলা। ক্রিকেটে কানাডাকে নিয়ে খুব বেশি দূর যেতে পারেননি। ক্যারিয়ারের পুরোটা সহযোগী দেশের ছকেই আটকে ছিলেন। তবে কানাডাকে নিয়ে ছোট স্বপ্ন বুনেছিলেন নিঃস্বার্থভাবে। কানাডার ক্রিকেটে আনন্দের উপলক্ষ্য যতবার এসেছে তার সিংহভাগেই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।
কানাডার ক্রিকেটের সাথে আশিষ বাগাই আষ্টেপৃষ্ঠে ছিলেন সেই ১৫ বছর বয়স থেকেই। অনূর্ধ্ব-১৫ দলের পর অনূর্ধ্ব-১৯ দল পেড়িয়ে সোজা জাতীয় দলে। একদম সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উপরে উঠেছেন তিনি। তাই কানাডাকে নিয়ে বড় একটা স্বপ্নও ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই দেখতে শুরু করেছিলেন বাগাই। বড় দলের বিপক্ষে ছোট দলের বড় তারকা বনে যাওয়ার মুহূর্ত রচনা করতেন প্রায়ই। এমন কিছুর আভাস অবশ্য দিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই।
একবার ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৫ দলের সাথে খেলা। ইংল্যান্ড সে ম্যাচ জিতে যায় অনায়াসেই। কিন্তু একা লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন আশিষ বাগাই। সে ম্যাচে অপরাজিত ৯১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। একা লড়াই করে জিততে পারেননি ঠিকই তবে অদম্য মানসিকতার বিচরণ শুরু তখন থেকেই।
২০০৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ। বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ। এর আগের কানাডা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে মোটে দুটি। তাও আবার সেই ১৯৭৯ সালে। কিন্তু অধিনায়কের আর্মব্যান্ড হাতে নিয়ে আশিষ বাগাই ম্যাচটা জিততে চাইলেন। বড় স্বপ্নের পথে পা বাড়ালেন। সতীর্থদের উদ্বুদ্ধ করলেন। অবাক বনে যাওয়ার মত ব্যাপার হল- দুই যুগ পর আন্তর্জাতিক মঞ্চে খেলতে নেমেই বাংলাদেশকে সে ম্যাচ হারিয়ে দিয়েছিল আশিষ বাগাইয়ের দল।
কানাডায় ক্রিকেটার পরিচয়ে জীবন চালানো বড্ড কঠিন। সেটা আশিষ বাগাই জানতেন আগে থেকেই। তাই ক্রিকেটের পাশাপাশি পড়াশোনাটা তিনি চালিয়ে গিয়েছিলেন। ২০০৬ সালে ইউনিভার্সিটি অব ওনটারিও থেকে তিনি স্নাতক পাশ করেন। আর সে বছরেই তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশতকের দেখা পান। নেদারল্যান্ডস, বারমুডা আর কানাডাকে নিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজে বাগাই হাফসেঞ্চুরি হাঁকান নেদারল্যান্ড, বারমুডা- দুই দলের বিপক্ষেই।
আশিষ বাগাই ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটিয়েছিলেন ২০০৭ সালে। সে বছরে ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১৩৭ রানের ইনিংস। যা এখনও কানাডার হয়ে এক দিনের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংসের রেকর্ড। ঐ টুর্নামেন্টেই তিনি আরো একটি সেঞ্চুরি করেন। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন ১২২ রানের ইনিংস। আর এমন পারফরম্যান্সের কারণে সে বছর তিনি আইসিসি সহযোগী দেশের সেরা ক্রিকেটার পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পান।
২০০৭ সালের মতই ২০১১ সালে দুর্দান্ত এক বছর কাটিয়েছিলেন বাগাই। তবে এবার সেটি বিশ্বকাপের মঞ্চে। কানাডা সেই বিশ্বকাপে একটি মাত্রই ম্যাচ জিতেছিল। কেনিয়ার বিপক্ষে সে ম্যাচে অর্ধশতক হাঁকিয়েছিলেন আশিষ বাগাই। এ ছাড়া পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই ব্যাট হাতে দারুণ ছন্দ দেখিয়েছিলেন তিনি।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে ৩৬৫ রানের পাহাড়সম লক্ষ্যে ৮৪ রানের ইনিংস খেলেছিলেন বাগাই। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও খেলেছিলেন ৩৯ রানের গুরুত্বপূর্ণ এক ইনিংস। সেবার দলগত ব্যর্থতায় মোটেই চাপা পড়ে যায়নি বাগাইয়ের এসব ইনিংস। ছোট দলের বড় তারকা হয়ে ঠিকই সেবার আলোচনায় এসেছিলেন তিনি।
২০১১ বিশ্বকাপের পর ক্রিকেট ছেড়ে আবারো পড়াশোনায় মনযোগ দেন আশিষ বাগাই। হোয়ার্টন স্কুলে এমবিএ’র ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে ভর্তি হন। পাশাপাশি ম্যাককিনসি নামক এক কোম্পানিতে যুক্ত হয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন তিনি। একই সাথে রজার্স স্পোর্টসনেটে অ্যানালিস্ট হিসেবেও যুক্ত হন বাগাই।
দুই বছর বাদে কানাডা ক্রিকেট বোর্ডের অনুরোধে আবারো ক্রিকেটে ফিরেছিলেন আশিষ বাগাই। তবে ক্রিকেটের সাথে বাগাইয়ের দ্বিতীয় পথচলাটা আর মসৃণ হয়নি। কানাডা ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ব্যর্থ হয়। যদিও কোয়ালিফায়ারে বাগাই দুটি ফিফটি হাঁকিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও সেখানেই ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেন আশিষ বাগাই। ২০১৩ সালে ২২ ডিসেম্বরে জানিয়ে দেন অবসরের ঘোষণা। ক্রিকেটের সাথে দীর্ঘ ১৫ বছর ক্যারিয়ারের ইতি টানেন এক টুইটের মাধ্যমে।
ক্রিকেট ইতিহাসে আশিষ বাগাই বড় কোনো তারকা নন। সহযোগী একটা দেশের ক্রিকেট নিয়ে হাল ধরেছিলেন তিনি। সে যাত্রার সিংহভাগই হয়তো ব্যর্থতায় মোড়ানো। কিন্তু যে টুকু তিনি করতে পেরেছেন কানাডার জন্য তা মোটাদাগের সাফল্য ছিল।
কানাডার ক্রিকেটকে একদম কাঁধে নিয়ে বেড়িয়েছেন এক যুগ পেড়িয়ে ১৫ টা বছর পর্যন্ত। আশিষ বাগাইয়ের অবসরের পরে ক্রিকেটে আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি কানাডা। তাদের ক্রিকেটটা এখন মিয়ম্রাণ হওয়ার পথে। এজন্য সে দেশেই নিত্যদিনে চাউর হয়, বাগাই যতদিন বাইশ গজে ছিলেন, ততদিন কানাডাও টিকে ছিল। একটা দেশের এমন একটা আক্ষেপের কেন্দ্রীভূত হওয়াও তো চাট্টিখানি কথা নয়।
হ্যাঁ, এমন কিছু হয়তো বাগাইকে আত্মতুষ্টিতে ভোগায় না। হয়তো তাঁর কাছে, যা করেছেন তা যৎসামান্যই। কিন্তু, ঐ যে ক্রিকেট ইতিহাসে সমৃদ্ধ পরিসংখ্যানওয়ালা ক্রিকেটার ছাড়াও আরো অনেকে আছেন। যাদের নিয়ে গল্প করা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। ক্রিকেট ইতিহাসে আশিষ বাগাই ঠিক তেমন একটা গল্পের নাম।