১৬ বছর ৩৫ দিন বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেঞ্চুরি। সবচেয়ে কম বয়সে টেস্ট সেঞ্চুরির বিশ্ব রেকর্ড, আজও অমলিন। ওই সময়টা বাংলাদেশে ক্রিকেট মানেই আশরাফুল। ছোটখাটো গড়ন, তীক্ষ্ণ চোখ, আর ব্যাটে যেন ছিল যাদু। ক্রিকেটকে বাংলার গলি-নালায় ফিরিয়ে আনার পেছনে যার ব্যাট ছিল সবথেকে বড় ‘ব্র্যান্ড’।
২০০১, কলম্বো। শ্রীলঙ্কার ঘরের মাঠ, চামিন্দা ভাস, মুরলীধরনদের সামনে বাংলাদেশের ব্যাটিং ধ্বসে পড়েছে। এক তরুণের আগমন, ঠোঁটের উপরে পড়েছে সবেমাত্র গোঁফের রেখা, দেখে মনে হয় যেন স্কুল ফেলে হঠাৎ ব্যাট হাতে ঢুকে পড়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। কিন্তু ক্রিজে দাঁড়িয়ে গড়লেন ইতিহাস, ১১৪ রান। যেখানে অন্যরা টিকতে পারেননি, সেখানে আশরাফুল খেললেন মহাকাব্যিক এক ইনিংস। শুরু হয় এক নতুন স্বপ্নের অধ্যায়।
এরপর একে একে আসে সেই ঝলমলে মুহূর্তগুলো: ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুর্দান্ত ১০০ রান, ২০০৭ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর ম্যাচে ৮৭ রানের ইনিংস, টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অভিষেক ম্যাচে ২০ বলে ফিফটি, আরো অনেক ছোট বড় বিস্ময়, আশরাফুল বনে যান বাংলাদেশি ক্রিকেটের পোস্টার বয়। সমস্যাও ছিল, এই গল্পটা ধারাবাহিক ছিল না।
একটা ৮০ রান আসত, তারপর পাঁচ ইনিংসে ৮ রান। ম্যাচ উইনার ইনিংস খেলতেন, পরের ম্যাচে হতেন রানআউটের কারণ। তাঁর নামেই একটা কথা চালু হয়েছিল, “আশরাফুল ইজ আনপ্রেডিক্টেবল”। আসলে, তিনি নিজেই নিজের ছায়া খুঁজতেন বারবার। কোনো এক অদৃশ্য চাপে, প্রতিভা আর পারফর্ম্যান্সের মাঝে দূরত্ব বাড়তেই থাকত। অবশ্য বাংলাদেশের কে-ই বা তখন ধারাবাহিক। আশরাফুল ইন্টেন্ট দেখাতেন, ম্যাচ জিততে চাইতেন।
২০০৭ সালে হয়েছিলেন জাতীয় দলের অধিনায়ক, সেই চাপ যেন তাঁকে আরো গুঁড়িয়ে দেয়। একটা সময় মনে হতে লাগল, আশরাফুল যেন নিজের প্রতিভার প্রতি অবিচার করছেন। আর ফেরা হয় নি সেভাবে। বরং হাজির হয়েছিলো সেই কালো অধ্যায়, ২০১৩ বিপিএল স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারি। কান্না জড়িত কন্ঠে সংবাদ সম্মেলনে স্বীকার করেন “ভুল করেছি, ক্ষমা চাচ্ছি”।
বাংলাদেশের মানুষ স্তব্ধ। যে ছেলেটা ছিল ক্রিকেটপ্রেমের মুখ, সে আজ অপরাধী। আইসিসি দেয় ৮ বছরের নিষেধাজ্ঞা, পরে অবশ্য কমে ৫ বছরে নেমে আসে। তিন বছর পরে ঘরোয়া ক্রিকেটে ফেরেন। কিন্তু সেই পুরনো ম্যাজিক আর ফিরল না। আশরাফুল রয়ে গেলেন অতীতের এক ঝিলিক হয়ে।
তাঁর প্রতিভা নিয়ে কখনো কারও প্রশ্ন ছিল না। সঞ্জয় মাঞ্জরেকার বলেছিলেন, ‘হি ইজ দ্যা মোস্ট ন্যাচারালি গিফটেড ব্যাটার ফ্রম সাবকন্টিনেন্ট আফটার মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন!’ কিন্তু আশরাফুল যেন নিজেই জানতেন না, কী আছে তাঁর ভেতরে। প্রতিবারই সেই প্রতিভা ছুঁয়ে চলে গেছেন, কখনো ধরে রাখতে পারেননি।
তাঁর গল্পটা একটা হারিয়ে যাওয়া সম্ভাবনার গল্প। একটা অসমাপ্ত আকাশ, যেখানে সূর্য ছিলো, সূর্যের আলো ছিলো, তেজ ছিলো, আর ছিলো ঘন-কালো কুয়াশা। আলো কিংবা তেজ দেখা গেলো না খুব বেশি। মোহাম্মদ আশরাফুল, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ অথচ সবচেয়ে উজ্জ্বল নামগুলোর একটা। হারিয়ে গেছেন, কিন্তু ভুলে যাওয়া যায় না। তিনি ভুলে যাবার নয়, আফসোস করার নাম।