আমি হারিয়ে যাওয়া ‍উল্কা

আতাউর রহমান – আমার নাম আপনারা কেউ শোনেন নি। ভুল বললাম, শুনেছেন হয় তো, মনে রাখেন নি। অধিনায়কের লিগামেন্ট ইনজুরি হয়েছে বলে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে। আমার একুশ বছর হতে তখন আর কয়েক দিন বাকি।

অনেকে বলেছিল অধিনায়ক নাকি পয়সা নিয়ে ভারতকে ম্যাচ ছেড়ে দিয়েছে। বললেই হল? আমার অধিনায়ক কে জানেন তো? সুইং এর সুলতান। তামাম বিশ্ব তখন খেলতে ভয় পায় আমার নেতাকে। আগের বিশ্বকাপে প্রায় একাই জিতিয়েছিল দেশকে। সে কী আনন্দ দেশ জুড়ে। শেষ ওভার বল করতে যাওয়ার আগে নাকি সে তাঁর অধিনায়ক কে বলত, চার রান যদি বাকি থাকে আমার জন্য, ম্যাচ আমাদের।

তো সেই অধিনায়কের জায়গায় আমি দলে এলাম। বদলি অধিনায়ক আমির সোহেল। ব্যাঙ্গালুরুতে টসে ভারত জিতল। ইয়ান চ্যাপেল কত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন ভারতের অধিনায়ককে। আগে ব্যাট, পরে ব্যাট ইত্যাদি। আমিরের বেলায় একটাই প্রশ্ন – সুলতান খেলছে না, বোলিং কী করে সামলাবে? আমির-আজহার দুজনের’ই কলার তোলা।

আমিরের বড় ঝুলফি তখন। কিন্তু আত্মবিশ্বাস যে টলে গিয়েছে সেটা বোঝা গেল। দু’বার করে বললো – এতে কোনো প্রভাব পড়বে না। আমরা আত্মবিশ্বাসী – একথাটাও দুবার বলল। যারা আত্মবিশ্বাসী হয় তারা বারবার বলে নাকি?

টসে হেরে বোলিং করতে নামলাম আমরা। পাটা পিচ, আগেই ব্যাট করতেই চাইত সবাই। আমিরের শুধু আত্মবিশ্বাস নয়, আমার ওপর বিশ্বাস’ও কম ছিল। সুলতানের জায়গায় বল করে এল আকিব, ওয়াকারের সাথে। আপনারা অরণ্যদেব পড়েছেন? অরণ্যদেবের আরেক নাম ছিল ওয়াকার। সুলতানের পার্টনার ওয়াকার – দুজনে মিলে কত উইকেট নিয়েছে আর নেবে তার ইয়ত্তা নেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছাড়া এরকম বোলিং অ্যাটাক নাকি কেউ কখন’ও দেখে নি।

যাক গে, আমি কিন্তু মুখিয়ে ছিলাম। টেনশন আর আত্মবিশ্বাসের মাঝামাঝি বুঝলেন। যারা ক্রীড়াবিজ্ঞান বোঝেন তারা জানবেন অল্প টেনশন ভাল। হরমোন ফ্লো করে দেহে। সাত ওভার শেষ হল, কুড়ি রান হয়েছে। উইকেট পড়ে নি। এটা কিন্তু খারাপ শুরু নয় – মানে তখনকার দিনে এইভাবেই প্রথম দিকের ওভারে রান হত। ২০২০ সালে বসে মেলাতে পারবেন না। আমীর হঠাৎ বলটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিল। ওয়াকারের ওভার বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে।

আমি এসেই কেলো করে ফেললাম। নয় রান দিয়ে দিলাম। বিশ্রী ব্যাপার, না? সাত ওভারে কুড়ির ফাঁস থেকে ভারতীয় ব্যাটিং বেরিয়ে এল। আকিব’ও উল্টোদিকে বেধড়ক মার খেয়ে গেল নভজ্যোৎ সিং সিধুর কাছে। আমি তারপর কয়েকটা ওভার চেক দিলাম। গরমে দম বেরিয়ে যাচ্ছে। ডে নাইট ম্যাচে ডে অংশটায় বড্ড গরম। ফিজিও ঢুকেছে মাঠে – আমি ততক্ষণে চার ওভারে একুশ দিয়েছি। নো উইকেট।

আমির বলে গেল থামাথামির ব্যাপার নেই, তুমি কমা বোলার – তোমায় টানা চালিয়ে যাব। আমার’ও জেদ চেপে গেছে – টানা ছয় ওভার করে ফেলেছি – পঁচিশ রান দিয়ে। সুলতানের জায়গায় টিম আমায় খেলিয়েছে। মাথা উঁচু করে বেরোতে হবে না? বাই দ্য ওয়ে অন্যদিকে এখন মুশতাক আহমেদ। সপ্তম ওভারের লাস্ট বলে বেদম হয়ে পিচের ওপরে ছুঁটে ফেলেছি। আম্পায়ার এসে সতর্ক করল। ছো কেউ এরকম ইচ্ছে করে করতে পারে? যেখানে সেকেন্ড ইনিংস আমাদের ব্যাট করতে হবে?

ক্রিকেট ব্যাটিংয়ের কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার একত্রিশ রানে ব্যাট করছে – আমার থেকে দু বছরের বড়। কী মারাত্মক সব রেকর্ড, আজকে কেন জানি একটু বেশি দেখে শুনে খেলছে। এই ছেলেটাই কার্স্টেনের করা ১৮৮ রানের রেকর্ড ভেঙে ওয়ান ডে ডাবল করে দেবে বলে চারিদিকে জোর আলোচনা। ছেলেটাকে পেয়ে গেলাম, শরীরের এত কাছে বলটা ঠেলে দিলাম যে কাট করার জায়গা পেল না।

ইনসাইডে লেগে তেকাঠির ওপরে আছড়ে পড়ল। দুটো হাত তুলে হাসতে হাসতে সবার দিকে এগিয়ে গেলাম – সুলতানের মুখ রাখতে পেরেছি তাহলে? এই উইকেট’টাই নাকি আসল? সারা স্টেডিয়াম চুপ করিয়ে দিয়েছিলাম জানেন – পিন পতন নীরবতা। পঞ্চান্ন হাজার মানুষের ভীড়ে শুধু টনি গ্রেগ কথা বলছেন।

যাক ম্যাচের কথা আর দীর্ঘায়িত করে লাভ নেই। টানটান উত্তেজনার ম্যাচ ব্যাটারদের নির্বুদ্ধতায় ভারতের হাতে তুলে দিয়ে আসতে হয়েছিল। স্কোরবোর্ডের কথা শুধু বলে যাই – টানা দশ ওভার বল করেছিলাম আমি। দশ ওভারে চল্লিশ রান দিয়ে শচীনের উইকেট। ওয়াকার আর আকিব দুজনেই ৬৭ রান দিয়েছিল দশ ওভারে। প্রায় ছয় ইকোনমি রেটে ২৮৭ রান করেছিল ভারত। আমার ইকনমি রেট ছিল চার আর দশ ওভার করা বাকি বোলারদের মধ্যে সব চেয়ে কম ইকনমি ছিল মুশতাকের – ফাইভ পয়েন্ট সিক্স।

আমি আতাউর রহমান। লিটল মাস্টার, সুইংয়ের সুলতান, আমির, আজহারদের মাঝে জ্বলে ওঠা এক উল্কা। যার নাম আপনারা জানেন না। বা জানলেও মনে রাখেন নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link