বলকে বেদম পেটানো খামখেয়ালি ‘ব্যাড বয়’

২০১৫ সালের অ্যাশেজ খেলতে ইংল্যান্ডে পৌঁছেছে অস্ট্রেলিয়া। দেড় বছর আগেই এই অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডকে শুধু ধবলধোলাই-ই করেনি, মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। জোনাথন ট্রট মানসিক অবসাদের জন্য বিরতিতে গেলেন, কেভিন পিটারসেনের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেল।

যাহোক, এরপর বিশ্বকাপও জিতল অজিরা। রীতিমতো দুর্দান্ত ফর্মে থাকা অবস্থায় ইংল্যান্ডে পৌঁছে প্রথম ট্যুর ম্যাচে কেন্টকে বিধ্বস্ত করল ২৫৫ রানে। পরের ম্যাচে এসেক্সকেও শেষদিনে প্রায় অসম্ভব ৩৭০ রানের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিল অজিরা।

চোটের কারণে এসেক্স হারিয়েছে দুই ব্যাটসম্যানকে। এর মধ্যে একজন টম ওয়েস্টলি, যিনি প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ১৪৪।

অধিনায়ক রবি বোপারা ইনিংসের গোড়াপত্তন করতে পাঠালেন জেসি রাইডারকে। মিচেল স্টার্কের প্রথম ওভার দেখেশুনে কাটিয়ে দিলেন জ্যাক মিকলবার্গ।

পরের ওভার করতে আসলেন জশ হ্যাজলউড। স্ট্রাইকে জেসি রাইডার। সেই ওভারের বিশ্লেষণ: ৪, ৪, ৬, ৪, ৪ নো-বল, ৪, ৪।

একে তো দুই ব্যাটসম্যান কম, তার উপর শেষদিনের পিচে ৩৭০ রানের লক্ষ্য। তার চেয়েও বড় কথা খেলাটা সাদা পোশাক আর লাল বলের। কিন্তু ব্যাটসম্যানটা জেসি রাইডার। ক্রিকেটটা যিনি খেলতেন বলকে মারার জন্যে, ঠেকানোর জন্যে নয়।

ছোটবেলায় রাইডারের বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায় আর রাইডার থেকে যান তার বাবার সাথে, নেপিয়ারে। রাইডার আর দশটা স্বাভাবিক কিশোরের মত বেড়ে ওঠার সুযোগ পাননি। কেননা তার বাবা বেরিয়ে যেতেন সকালে, আসতেন মধ্যরাতে। তাই বাবার সাথে দেখা হওয়ার খুব একটা সুযোগও হত না৷ একাকী রাইডারও তাই বাইরে বাইরে ঘোরা শুরু করলেন। দেখা গেল, সপ্তাহে দুই কি তিনবার বাড়িতে আসছেন।

রাইডারের বয়স যখন ১৪, তখন এক বন্ধুর বাসায় তাকে রেখে একপ্রকার পালিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান তার বাবা। তার মা থাকতেন অন্য জায়গায়, আর রাইডারও চাননি নেপিয়ার ছেড়ে কোথাও যেতে। সময়টা কঠিন ছিল তার জন্যে। রাইডার বন্ধুদের সাথে থাকা শুরু করলেন, অ্যালকোহল পানের নেশা তৈরি হল তখন থেকেই। যদিও শুরুতে এটা তাঁর ক্রিকেটকে বাঁধাগ্রস্ত করেনি।

দু’বছরের মাঝে সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্টসের অনূর্ধ্ব-১৭ দলে সুযোগ পেয়ে যান রাইডার। ১৮ বছর বয়সে নিউজিল্যান্ড অ্যাকাডেমী দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়া অ্যাকাডেমির বিপক্ষে ১৮১ রানের ইনিংস দিয়ে জায়গা করে নেন নিউজিল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। ২০০২ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন নিউজিল্যান্ডের পক্ষে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। সেই দলে আরও ছিলেন রস টেলর, নিল ব্রুম, রব নিকোল আর পিটার বোরেন। হ্যাঁ, নেদারল্যান্ডসের সাবেক অধিনায়ক পিটার বোরেন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলেছেন নিউজিল্যান্ডের হয়ে।

নিউজিল্যান্ড এ দলে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পরেও জাতীয় দলে বারবার উপেক্ষিত হচ্ছিলেন রাইডার। তাই নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেলার আশা পরিত্যাগ করলেন।

ইতোমধ্যে আয়ারল্যান্ড থেকে খেলার প্রস্তাব আসল, ম্যাচপ্রতি হাজার ইউরো। তার জন্যে যেতে হবে লন্ডনে। কিন্তু জেসি রাইডার যথাসময়ে বিমান ধর‍তে ব্যর্থ হন, ফলে স্বাভাবিকভাবেই চুক্তি বাতিল হয়ে যায়।

যাহোক, তখনও নিউজিল্যান্ডের হয়ে না খেলার সিদ্ধান্তে অটল রাইডার। ইংল্যান্ডে গিয়ে ক্লাব ক্রিকেট খেললেন, সফলও হলেন। তার দাদা-নানা দু’জনেই ব্রিটিশ হওয়ায় ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার স্বপ্নও দেখেছিলেন রাইডার। কিন্তু সে আশাও পূরণ হয়নি।

অগত্যা নিউজিল্যান্ডেই ফিরে আসলেন। অবশেষে ২০০৮ এর ফেব্রুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডের হয়ে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হল রাইডারের। প্রথম ম্যাচ খেললেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, যাদের হয়ে খেলার স্বপ্ন কিছুদিন আগেও দেখছিলেন রাইডার৷ ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওয়ানডেতেই সামর্থ্যের জানান দিলেন ৬২ বলে অপরাজিত ৭৯ রানের ইনিংস খেলে।

কিন্তু এই সিরিজের পরপরই বারে মারামারিতে লিপ্ত হন রাইডার, যাতে হাতে চোট পান। হাসপাতালে মেডিকেল স্টাফের সাথে দুর্ব্যবহার করেন, যার দরুন তিন মাসের জন্য নিষিদ্ধ হন।

এই শেষ নয়। পরের বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের নিউজিল্যান্ড সফরের সময় রাতভর মদ্যপান করার কারণে সকালবেলায় টিম মিটিংয়ে অনুপস্থিত ছিলেন রাইডার। ফলে পরের ম্যাচেই দল থেকে বাদ পড়েন তিনি।

কিন্তু ব্যাটিংয়ে সাফল্য অব্যাহত ছিল রাইডারের৷ সে বছরই ভারতের বিপক্ষে সিরিজে ৫৬ গড়ে করেন ২২৫ রান, যা নিউজিল্যান্ডের পক্ষে সর্বোচ্চ। টেস্ট সিরিজেও তার দলের কেউ তার থেকে বেশি রান করতে পারেননি। ৬৫ গড়ে ২ শতকের সাহায্যে সিরিজে ৩২৭ রান করেন রাইডার, যার একটি ছিল ডাবল সেঞ্চুরি।

২০০৯ সালে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট অ্যালমানাকের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন রাইডার।

কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন ও মাঠের বাইরের বিতর্ক তার ব্যাটিং সাফল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল। রাইডার যখন ব্যাট হাতে সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান করছিলেন, তখন চোট সমস্যা, ফিটনেস ও ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ক্রিকেট থেকে বিরতি নেন তিনি।

২০১৩ সালের মার্চে ক্রাইস্টচার্চের এক বারের বাইরে বাদানুবাদের এক পর্যায়ে প্রচণ্ড মারধরের শিকার হন। মরণাপন্ন অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে দেখা যায় তার মাথার খুলি আর ফুসফুস বেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়ে একসময় কোমায় চলে গিয়েছিলেন।

কিন্তু সে যাত্রায় বেঁচে ফেরা রাইডার সে বছরের শেষদিকে আবারও দলে ফেরেন। নববর্ষের দিনে শহীদ আফ্রিদির রেকর্ড ভেঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩৬ বলে সেঞ্চুরি হাঁকান কোরি অ্যান্ডারসন। জেসি রাইডারের সাথে তার জুটি ছিল ১৯১ রানের, যা এসেছিল মাত্র ৭৫ বলে৷ রাইডারের সেঞ্চুরি এসেছিল ৪৬ বলে, যা একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অষ্টম দ্রততম সেঞ্চুরি।

কিছুদিন পরই ভারতের বিপক্ষে সিরিজ। ইডেন পার্কের সেই বিখ্যাত টাই ম্যাচ হয়েছিল যে সিরিজে। সেই ম্যাচের পর জিমি নিশামের সাথে অকল্যান্ডের এক বারের বাইরে মদ্যপ অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল রাইডারকে।

যাহোক, টেস্ট সিরিজের জন্য ঘোষিত দলে রস টেলরের ব্যাকআপ হিসেবে জায়গা পেয়েছিলেন তিনি। ম্যাচের আগে-পরে মদ্যপান করা সম্ভবত অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল রাইডারের। প্রথম ম্যাচের আগে সতীর্থ ডগ ব্রেসওয়েলের সাথে মদ্যপান করেন ও রাত দুটোর সময় বার ত্যাগ করেন।

দ্বিতীয় টেস্টে সু্যোগ ছিল রাইডারকে খেলানোর। কিন্তু বোর্ডের সিদ্ধান্ত ছিল ‘যথেষ্ট হয়েছে;। আর কখনোই নিউজিল্যান্ডের জার্সি গায়ে চাপাতে পারেননি তিনি।

এভাবেই শেষ হয় সম্ভবত নিউজিল্যান্ডের সবচাইতে প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৪৫ গড় কিংবা সংক্ষিপ্ততম সংস্করণে ১৪৫ স্ট্রাইকরেট নয়, তাই জেসি রাইডার নামটা মনে পড়লে সবার আগে যে ছবিটা আপনার সামনে ভেসে ওঠে, সেটা হল মাঠের বাইরে বারবার কেলেঙ্কারিতে জড়ানো আনফিট, মদ্যপ এক ক্রিকেটার। মোহাম্মদ আশরাফুল, উমর আকমলদের মত জেসি রাইডারও প্রতিভা হেলায় নষ্ট করার আরেকটি ক্লাসিক উদাহরণ।

জেসি রাইডার শুধু নিউজিল্যান্ড নয়, ক্রিকেটের ইতিহাসেরই বড় একটা আক্ষেপের নাম। ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, ডেভিড ওয়ার্নার, রোহিত শর্মা, জেসন রয়দের পাশে নিজের নাম উচ্চারিত হওয়ার সুযোগটা আপনি অতি অবহেলে নষ্ট করলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link