বিদেশ বিভূঁই থেকে দেশের কথা ভুলতে না পারা মাইকেল মধূসুদন দত্ত লিখেছিলেন ‘কপোতাক্ষ নদ’। যে কবি চেয়েছিলেন ইউরোপীয় সাহিত্য আঙিনায় নিজের একখানা ছোট্ট জায়গা তৈরি করে নিতে, নামও খানিক পরিবর্তন করেছিলেন ভিনদেশিদের সাথে মিশে যেতে। সে কবি দেশের মায়ার টানে সকল সম্ভাবনা, আয়েসি জীবন কিংবা অকল্পনীয় সুযোগের হাতছানি উপেক্ষা করে ফিরে এসেছিলেন তাঁর ছোট্ট গাঁয়ের নদীটির তীরে।
মাতৃভূমি কিংবা স্বদেশের টানে বারবার ফিরে আসার গল্প রয়েছে আমাদের চারিপাশে। তারই এক উদাহরণ জামাল ভূঁইয়া। স্বদেশের মায়ার টানে, দেশের ফুটবলের টানে সুদুর প্রবাসের উন্নত জীবনের লোভ সংবরণ করে বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছেন ডেনমার্ক থেকে জামাল ভূঁইয়া।
যে জামাল ভূঁইয়ার কাছে সুযোগ ছিলো ইউরোপিয়ান লিগে খেলার, ডেনমার্কের জাতীয় দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করবার, সেই জামাল ভূঁইয়া ধুকতে থাকা বাংলাদেশ ফুটবলের নেতৃত্বের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। পেয়েছেন ভক্তদের অন্ধ ভালবাসা ও পূর্ণ সমর্থন। জামাল এখন বাংলাদেশ ফুটবলের ‘পোষ্টার বয়’।
জামালের দেখানো পথ ধরে পিতৃভুমির উর্বর জমিতে ফুটবলের সোনালী ফসল ফলাতে হাজির ফিনল্যান্ড প্রবাসী তারিক কাজী। এসে সময় নিয়েছেন, বুঝেছেন, দেখেছেন এবং শেষমেশ জয় কর নিয়েছেন বাংলাদেশের ফুটবল সমর্থকদের আস্থা আর রক্ষণে নিজের জায়গা। এখন জাতীয় দলের রক্ষণের অন্যতম সেরা সেনানি তারিক কাজীতে রক্ষণ সামলানোর মতো গুরুদায়িত্ব যেমন অর্পিত তেমনি উইং থেকে আক্রমণ চালানোর ভারও তাঁর বলিষ্ঠ কাঁধেই।
জামাল, তারিকদের অনুসরণ করে বাংলাদেশ ফুটবল দলের জার্সি গায়ে জড়িয়েছিলেন কানাডা প্রবাসি রাহবার খান ও ফান্স প্রবাসি তাহমিদ ইসলাম। এবার তাদের উত্তোরসূরি হয়ে দেশে আসতে চলেছেন ইংল্যান্ড প্রবাসী ইউসুফ জুলকারনাইন হক।
জামাল, তারিক শক্ত করেছেন মধ্যমাঠ আর রক্ষণ। মধ্যমাঠ আর রক্ষণে হয়ত প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করে পাল্টা আক্রমণ সাজানো যায়। কিন্তু গোলটা যে আদায় করতে হয় আক্রমণ ভাগের দুদক্ষ খেলোয়াড়দেরকেই। বাংলাদেশ যেন ঠিক এই জায়গাটাতে পিছিয়ে রয়েছে এক আলোকবর্ষ কিংবা তার থেকে একটু কাছাকাছি দূরত্বে।
আক্রমণের এই দূর্বলতা কাটাতে হিমসিম খেয়েছেন বহু কোচ। কিন্তু উপায় মেলেনি কখনোই। নতুন এক টোটকা হিসেবে নাইজেরিয়ান নাগরিকত্ব পরিবর্তনকারী এলিটা কিংসলেকে সাফের দলে ডেকেছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের অন্তর্বর্তীকালিন কোচ অস্কার ব্রুজন। অন্যদিকে এই আক্রমণের অপারগতা মাথায় রেখে অনূর্ধ্ব ২৩ দলের প্রাথমিক দলে সুদূর সাত সাগর তের নদী দূরে থাকা ইউসুফ জুলকারনাইনকে দলের সাথে যোগ দিতে খবর পাঠিয়েছে বাফুফে।
আসন্ন এএফসি আয়োজিত অনুর্ধ্ব ২৩ এশিয়ান কাপ ২০২২ এর বাছাই পর্বকে সামনে রেখে ঘোষণা করা হয়েছে ৩৮ সদস্যের বাংলাদেশের প্রাথমিক দল। প্রাথমিক সেই দলে ডাক পেয়েছেন আঠারো বছর বয়সী তরুন ফুটবলার ইউসুফ জুলকারনাইন। তিনি বর্তমানে ইংলিশ তৃতীয় বিভাগ লিগের দল ইপ্সউইচ টাউন ফুটবল ক্লাবের একজন নিয়মিত সদস্য।
সম্ভাবনাময়ী জুলকারনাইন আক্রমণ ভাগের একজন সুদক্ষ খেলোয়াড়। তিনি তাঁর ক্লাব ইপ্সউইচ টাউনের অনূর্ধ্ব ১৮ ও অনূর্ধ্ব ২৩ দলের একজন নির্ভরযোগ্য উইঙ্গার, সমানভাবে পারদর্শী স্ট্রাইকার হিসেবেও খেলতে। বাংলাদেশ জাতীয় দলের অন্তর্বর্তীকালীন কোচ অস্কার ব্রুজোন দায়িত্ব গ্রহণের আগে সাফের প্রাথমিক দলে জুলকারনাইনের অন্তর্ভূক্তির গুঞ্জন শোনা গেলেও তা আর বাস্তবে রুপ নেয়নি।
কিন্তু জুলকারনাইনের দক্ষতা আর তাঁর সম্ভাবনাকে হেলায় হারিয়ে ফেলতে অনিচ্ছুক বাফুফে। তাছাড়া গোলের খরা দূর করতে তাঁর মতো তরুণ ফুটবলারদের শক্তিমত্তা যাচাই করা এবং তাদেরকে পরবর্তীতে জাতীয় দলের জন্য প্রস্তুত করা অত্যন্ত জরুরী। খানিক দেরীতে হলেও বাফুফে বদ্ধপরিকর এমন সকল সম্ভাবনাময়ী প্রবাসি কিংবা স্থানীয় খেলোয়াড়দেরকে সুযোগ দিতে। তাই হয়ত সাফের দলে জায়গা দিতে না পারলেও অনূর্ধ্ব ২৩ দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছেন জুলকারনাইন।
বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব ২৩ দলে জুলকারনাইনের পাশাপাশি রয়েছেন আরেক প্রবাসি খেলোয়াড় তারিক কাজি। যিনি ইতিমধ্যে জাতীয় দলের হয়ে তার সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছেন। তবে ৩৮ সদস্যের এই দলে জায়গা হয়নি বসুন্ধরা কিংসের কাতার প্রবাসি খেলোয়াড় ওবায়দুর রহমান নবাবের।
অক্টোবরের ২৩-৩১ তারিখের মধ্যে বাছাইপর্ব অনুষ্ঠিত হবে। এগারোটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বাছাইপর্বে লড়বে ৪১টি দল। গ্রুপ ডি-তে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ সৌদি আরব, উজবেকিস্তান ও স্বাগতিক কুয়েত। মূল দলে সুযোগের আপ্রাণ চেষ্টা হয়ত চালাবেন জুলকারনাইন।
তাঁর সেই সক্ষমতা ও রয়েছে। ফুটবলে উন্মাদ এই জাতি আরো একটি বার তাদের সব প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষায় রইবেন ইউসুফ জুলকারনাইনের মূল দলে অন্তর্ভুক্তির। তাঁর হাত ধরে গোলের খড়া ঘুচবে কি না তা অবশ্য সময় সাপেক্ষ তবে স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নেই। নতুন স্বপ্ন বুনন হবে, বাস্তব আর স্বপ্নের ফারাক যাচাই করবে সূর্যের গতি।