পঞ্চপাণ্ডব – মূল শব্দটা এসেছে মহাভারত থেকে।
মহাভারতে বর্ণিত পান্ডুর পাঁচ পুত্র – যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেবকে বলা হয় পঞ্চপাণ্ডব। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে পঞ্চপান্ডব শব্দটার আবেদন একটু আলাদা। মূলত দলের পাঁচ সিনিয়র ক্রিকেটার – মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আর তামিম ইকবালকে উপমার্থে ডাকা হয় পঞ্চপাণ্ডব নামে।
বাংলাদেশ গত ১২ বছরে যে কয়টি ম্যাচ জিতেছে, প্রত্যেকটিতেই কোন না কোনভাবে আছে এই পঞ্চপাণ্ডবের অবদান। কখনও বা মাশরাফি দুর্দান্ত স্পেলে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছেন, কখনও সাকিব আল হাসান অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্সে চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছেন, কখনও তামিম ইকবালের দুর্দান্ত শুরু এনে দিয়েছেন, কখনও মুশফিক হয়েছেন ধারাবাহিকতার প্রতিমূর্তি আর কখনও বা শেষদিকে এসে অবদান রেখেছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
তবে এই জগতের সবকিছুই একদিন অন্তিম মুহুর্তে পৌছাবে, সবাইকেই একদিন থামতে হবে, ভয়ংকর সুপারনোভা দিয়ে মরে যাবে নক্ষত্রেরা, এনট্রপি পৌছে যাবে শূণ্যে। একদিন তো বাংলাদেশকে খেলতে নামতে হবে কথিত ‘পঞ্চপাণ্ডব’ ছাড়াই!
‘হবে’ বললাম কেন? হয়েই তো গেছে!
পাক্কা ১৫ বছর ১ মাস ৪ দিন পর – ঠিক পঞ্চম দিনের দুপুরে বাংলাদেশ আবার খেলতে নামছে দলের সিনিয়র পাঁচ ক্রিকেটার ছাড়াই!
বছর-মাস বাদে দিনের হিসেবে সংখ্যাটা ৫৫১১; একেবারে কম না কিন্তু। ঠিক এই কয়দিন আগে ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সাগরিকার পাড় চট্টগ্রামে শ্রীলঙ্কার সাথে টেস্ট খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ। সে ম্যাচে বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন হাবিবুল বাসার সুমন।
প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ যে খুব খারাপ করেছিল এমনটা বলা যাবেনা, মোহাম্মদ আশরাফুলের সেঞ্চুরির সুবাদে বাংলাদেশ গড়েছিল ৩১৯ রানের এক মধ্যবিত্ত সংগ্রহ। আবার ৩১৯ রানে পিছিয়ে থেকে ব্যাট করতে নামা শ্রীলঙ্কাকেও বাংলাদেশ প্যাকেটবন্দী করে ফেলেছিল ৩৩৮ রানের মধ্যেই।
তবে দ্বিতীয় ইনিংসে গিয়ে আবার সেই চিরচেনা দৃশ্য, পরিচিত বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেট । মুত্তিয়া মুরালিধরণের স্পিনের ভেলকি সামলাতে না পেরে ১৮১ রানেই অলআউট!
বাংলাদেশ সে ম্যাচটা হেরেছিল। আট উইকেটের বিশাল ব্যাবধানে হারা বাংলাদেশের সেটাই শেষ ম্যাচ ছিল যেদিন পাঁচ সিনিয়রের কেউই খেলেনি।
সে ম্যাচ অবশ্য ছিল দেশের মাটিতে। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ পাঁচজনের কাউকে ছাড়াই খেলতে নামে এরও আগের বছর, ২০০৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর- এখন থেকে যেটা ১৫ বছর ৬ মাস ১২ দিন আগে!
কলম্বোর পাইকিয়াসোথি সারাভানামুত্তু স্টেডিয়াম, আপনি যাকে চেনেন পি.সারা. ওভাল নামে! সে ম্যাচেও মারভান আতাপাত্তুর শ্রীলঙ্কার সামনে বাংলাদেশের অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন। তবে এবার আর আশরাফুল ম্যাজিকেও রান হয়নি। মূলত শ্রীলঙ্কা প্রথম ইনিংসেই ৪৫৭ করে ফেলায় বাংলাদেশ মনস্তাত্ত্বিকভাবে পিছিয়ে পড়ে ওখানেই। দলের হয়ে প্রথম ইনিংসে সর্বোচ্চ রান করেন মোহাম্মদ আশরাফুল, সেটাও আবার মাত্র ৪২। বাংলাদেশ সে ম্যাচে শেষ অব্দি বরণ করেছিল ইনিংস পরাজয়, শ্রীলঙ্কা জিতেছিল ইনিংস ও ৬৯ রানের বিশাল ব্যাবধানে।
যে দুটো ম্যাচের গল্প বলে ফেললাম, দুটোই ছিল সাদা পোশাকে। ওয়ানডেতে বাংলাদেশ এই পাঁচজনের কাউকে ছাড়াই খেলতে নামে এমন ঘটনা ঘটে ২০০৫ এর শ্রীলঙ্কা সফরের ওয়ানডে সিরিজেই। ২০০৫ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে ফিরে যেতে হবে ১৫ বছর ৬ মাস ২৮ দিন আগে। ভেন্যু এবারও কলম্বোর সেই পি.সারা ওভাল।
বাংলাদেশের হয়ে এবারও টস করতে নামা অধিনায়ক সেই হাবিবুল বাশারই। তবে অধিনায়কের মত বাংলাদেশের ভাগ্যও সেবার পরিবর্তন হয়নি, বরং পড়তে হয়েছিল ভীষণ লজ্জায়। পারভেজ মাহরুফ আর দিলহারা ফার্নান্দোর বোলিং তোপে বাংলাদেশ ১০৮ রানেই গুটিয়ে গেলে শ্রীলঙ্কা ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে ম্যাচটা জিতে নেয় ২১.২ ওভারেই!
বিদেশ বিভূঁই ছাড়া দেশের মাটিতে পাঁচজনের কাউকে ছাড়াই বাংলাদেশ অবশ্য ওয়ানডে খেলতে নামে এই তিন ঘটনারও আগে, ২০ জানুয়ারী ২০০৫ সালে! ১৬ বছর ২ মাস ১২ দিন আগের সে ম্যাচটার প্রতিপক্ষ অবশ্য ছিল জিম্বাবুয়ে, টাটেন্ডো টাইবুর সামনে এবারও বাংলাদেশের অধিনায়ক হাবিবুল বাশার!
সে ম্যাচে খালেদ মাহমুদ আর তাপশ বৈশ্য দুটি করে উইকেট নিলেও জিম্বাবুয়ের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৫১ তে! ২৫২ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশের হয়ে অবশ্য রাজিন সালেহ আর মোহাম্মদ আশরাফুল ছাড়া কেউ সুবিধা করতে পারেননি। ফলাফল? এবারও ম্যাচ হার! ২২৯ রানে গুটিয়ে গিয়ে ২২ রানে ম্যাচ হারা বাংলাদেশের ওটাই ছিল দেশের মাটিতে সাকিব-তামিম-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ-মাশরাফি বিহীন শেষ ওয়ানডে ম্যাচ!
বাংলাদেশ আজকেও খেলতে নেমেছে এই পাঁচজনকে ছাড়া। তবে এ ম্যাচের মাহাত্ম্য উপরের চার ঘটবার চেয়ে একটু ভিন্ন। দেশ হোক বা বিদেশ, বাংলাদেশ যে টি-টোয়েন্টিতে তাঁর পাঁচ সিনিয়রকে ছাড়া কোনোদিনই খেলতে নামেনি!
তা না নামুক, বিদেশের মাটিতে পাঁচ সিনিয়র ছাড়া বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টির হালখাতা হয়ে যাচ্ছে। একদিন হয়ে যাবে দেশের মাটিতেও আর একদিন নিয়মিত ভাবেই বাংলাদেশ খেলতে নামবে তাঁর পাঁচ সিনিয়রকে ছাড়াই!
সবাইকেই একদিন থামতে হয়, স্টেশন বদল হয়, প্লাটফর্মে যাত্রীবদল হয়, কিন্তু ট্রেন ঠিকই ছুটে যায়। বাংলাদেশেরও স্টেশন বদলাবে, কিন্তু ট্রেন ঠিকই ছুটে যাবে আপন গতিতে, ছুটতে যে তাঁকে হবেই!