সেটা ২০০২ সালের কথা। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ তখন হাটি হাটি পা করছে। সদ্যজাত শিশুর মত অনভিজ্ঞ বাংলাদেশ গিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে।
ইস্ট লন্ডনে প্রথম টেস্ট। টসে জিতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিলো বাংলাদেশ। সেই টেস্ট কাভার করা সাংবাদিক উৎপল শুভ্র স্মৃতিচারণ করে ক’দিন আগেই লিখেছেন, “পরদিন দক্ষিণ আফ্রিকার এক পত্রিকায় লেখা হলো, ‘বাংলাদেশ টসে জিতেছে এবং প্রথম ব্যাটিং করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।”
সোজা কথায় বলা হলো-দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটে ফাস্ট বোলারদের সামনে প্রথম সেশনে বাংলাদেশ ব্যাটিং করতে ভয় পেয়েছে।
সেটা ছিলো খালেদ মাসুদ পাইলটের দল। সেই সময় বাংলাদেশ দল প্রথম সেশনের নিউল্যান্ডে ক্যালিস, এনটিনিদের খেলতে ভয় পেলে খুব নিন্দা করার কিছু নেই। এমনকি ২০০৮ সালে মোহাম্মদ আশরাফুলের দল যখন একই কাজ করে, তাতেও আমি লজ্জার কিছু দেখি না।
২০০৮ সালে ব্লুমফন্টেইনেও টসে জিতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাংলাদেশ। তখন অধিনায়ক ছিলেন আশরাফুল। তামিমরাও তখনও স্টেইন, মরকেলদের সামনে প্রথম সেশনে ব্যাট করার ঝুঁকি নিতে চাননি।
এই ভয়টার কারণ খুব সোজা। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো সেনা দেশগুলোতে প্রথম দিনের প্রথম সেশনে উইকেটে ফাস্ট বোলাররা খুব সহায়তা পেয়ে থাকেন। বল পড়ে দূরন্ত বেগে শরীরের দিকে ধেয়ে আসে। ফলে ভয় লাগতেই পারে।
কিন্তু এই ২০২২ সালে এসেও সেই ভয় লাগবে?
অবস্থাদৃষ্টে তো তাই মনে হচ্ছে। ডারবানে বাংলাদেশ টসে জিতে সেই পাইলট-আশরাফুলদের জামানার মতোই কাজ করেছে। ব্যাটিং করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তাহলে এই ১৪ বছরে বাংলাদেশ কতটুকু এগোলো?
পারফরম্যান্সে বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়ে গেছে।
এই সময়ে বাংলাদেশ স্পিন নির্ভর মাথা নিচু করা দল থেকে পেস বোলারদের একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে। দেশের মাটিতে নিচু ও ধীর উইকেটে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডকে হারানোটা এখন আর গল্প নয়। এখন গল্পের বিষয়-মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্ট।
নিউজিল্যান্ডের মাটিতে গিয়ে বাংলাদেশি ফাস্ট বোলাররা ত্রাস তৈরি করে ফেলে। এবাদত, খালেদরা এখন সেনা কান্ট্রিতে গিয়ে নিউজিল্যান্ডকেই ভয় ধরিয়ে দিতে পারেন। এখন আর বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানরা ফাস্ট বলের নাম শুনলেই ভয়ে গুটিয়ে যান না। মাহমুদুল হাসান জয়, লিটন দাসরা এখন বুক চিতিয়ে সামাল দেন গতি গোলা।
কিন্তু এই বদলে গিয়ে লাভ কী হলো? মননে তো আমরা এখনও সেই ২০০২ বা ২০০৮ সালে পড়ে আছি। এখনও তো আমরা আগে ব্যাট করতে ভয় পাই?
কে ভয় পায়?
কাগজে কলমে ভয়টা নিশ্চয়ই কোচ-অধিনায়ক পেয়েছিলেন। তাই দায়টা মুমিনুল হক আর রাসেল ডমিঙ্গোকে নিতে হয়েছে। আমরা ভেবেছি, তারাই বুঝি আগে ব্যাট করতে ভয় পেয়েছেন। কিন্তু ‘দৈনিক সমকাল’ পত্রিকা বলছে, এই আগে ব্যাট করতে আপত্তিটা নাকি এসেছে মূলত দুই সিনিয়র ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে। পত্রিকাটির ভেতরের সূত্র দাবি করেছে, তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিম আগে ব্যাট করার রাজি হননি!
এই খবর সত্যি হলে আমাদের মেনে নিতে হবে যে, তামিম-মুশফিকদের প্রজন্ম আসলে পাইলট-সুজনদের সময় থেকে খুব একটা মানসিকতায় এগোতে পারেননি। তারা দেশের সেরা ব্যাটসম্যান। কিন্তু এখনও চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতাটা গড়ে তুলতে পারেননি। এটা নিশ্চয়ই দু:খজনক ব্যাপার।
আমরা বাঙালিরা কখনোই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জাতি হিসেবে খুব সুনাম করতে পারিনি। ক্রিকেটে দু একটা ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের দুর্নাম রয়েছে এই পলায়নবৃত্তির। কিন্তু দিন বদলাচ্ছে। এখন সেই যুগ আর নেই। এখনকার ছেলে-মেয়েরা চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে। এগিয়ে এসে ফাস্ট বলে ছক্কা মারতে পারে।
ফলে নিজেদের প্রজন্মের নেতিবাচকতা লুকিয়ে এই যগের সাথে তামিম-মুশফিকরা তাল মেলানোর চেষ্টা করবেন, এটাই আশা করা যেতে পারে। আর কত পালাবো আমরা?