অ্যালিসন বেকার, ভাগ্যের দ্বাররক্ষক

২০২১/২২ মৌসুমে রীতিমতো বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিল লিভারপুল। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জায়গা পেতে প্রিমিয়ার লিগের শেষ ম্যাচে জয়ের কোন বিকল্প ছিল না তাদের সামনে। কিন্তু নির্ধারিত নব্বই মিনিট শেষে ওয়েস্ট ব্রুমের বিপক্ষে ১-১ গোলে সমতায় ছিল অলরেডরা। অতিরিক্ত সময়ের ৪ মিনিটও প্রায় শেষ। অপেক্ষা তখন শেষ বাঁশি বেজে উঠার। লিভারপুলের কর্ণার মারা শেষ হলেই সেটা বেজে উঠবে, এমন সময় লাল, সাদা-নীল খেলোয়াড়ের মাঝে লিভারপুল গোলরক্ষককে দেখে বিস্মিত হয়েছিল সবাই।

এরপর যা হয়েছে সেটা অবিশ্বাস্য, আলেক্সান্ডার আর্নল্ডের মাপা কর্নারে মাথা ছুঁইয়ে ফুটবলপ্রেমীদের চমকে দিলেন লিভারপুলের গোলরক্ষক। প্রথম গোলরক্ষক হিসেবে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে হেডে গোল দিলেন তিনি, তাঁর নাম যে অ্যালিসন বেকার সেটি না বললেও বোধহয় বুঝে যাওয়ারই কথা।

অথচ ২০১৮ সালে তৎকালীন রেকর্ড ট্রান্সফার ফি-তে দলে ভেড়ানোতে টিপ্পনী উঠেছিল ঢ়ের। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেসব আর ধোপে টেকেনি। অলরেডদের গোলপোস্ট সামলানো অ্যালিসন নিজেই থামিয়ে দিয়েছেন নিন্দুকদের, যেমনটা থামিয়ে দেন প্রতিপক্ষের দুর্ধর্ষ সব শটকে। নিজের পারফরম্যান্স দিয়েই সব সমালোচনার জবাব দিয়েছেন তিনি।

ব্রাজিলের রিও গ্র্যান্ডে ডো সুল রাজ্যে ১৯৯২ সালের ২ অক্টোবর জন্ম নেন অ্যালিসন বেকার। ব্রাজিলের অন্যসব শিশুর মতই ফুটবলে আসক্ত হতে দেরি হয়নি তাঁর। তবে অন্যদের মত গোল করা নয়, অ্যালিসনের ইচ্ছে ছিল গোল থামানোর। তাই তো বেছে নিয়েছিলেন গোলরক্ষকের পজিশন।

অ্যালিসনের মা ছিলেন স্কুল হ্যান্ডবল দলের গোলরক্ষক। এবং তাঁর বাবা নিজের কোম্পানির ফুটবল দলের গোলরক্ষক ছিলেন। এছাড়া বাবার দাদা ছিলেন নভো হামবুর্গ শহরের অপেশাদার একটা দলের গোলরক্ষক ছিলেন। আবার অ্যালিসনের বড় ভাই মুরিয়েলও একজন গোলরক্ষক ছিলেন। তাই বলাই যায়, গোলকিপার হয়ে উঠার জন্যই হয়তো জন্ম হয়েছে অ্যালিসন বেকারের।

২০০২/০৩ মৌসুমে, মাত্র ১০ বছর বয়সে, ব্রাজিলীয় ফুটবল ক্লাব ইন্তেরনাসিওনালের যুব পর্যায়ের হয়ে খেলার মাধ্যমে পেশাদার ফুটবল জগতে প্রবেশ করেন অ্যালিসন বেকার। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর উচ্চতা, সমবয়সীদের তুলনায় অ্যালিসন ছিলেন অনেক বেশি বেঁটে। তাই দলের ব্যাকআপ গোলকিপার হিসেবেই কাটাতে হয় তাঁকে।

এমনকি এক পর্যায়ে ইন্তেরনাসিওনাল অ্যালিসন বেকারকে বাদ দেয়ার পরিকল্পনা শুরু করে। শেষপর্যন্ত ক্লাব ম্যানেজম্যান্ট আর এক বছর অ্যালিসনের শারিরীক বিকাশ পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর এসময়ই দ্রুত লম্বা হতে শুরু করেন তিনি, সেই সাথে নজর কাড়েন গোলকিপিং টেকনিক দিয়েও। সবমিলিয়ে এক বছরের মধ্যেই চারপাশের পরিস্থিতি বদলে যায়, বাদ পড়ার দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে এসে তিনি হয়ে ওঠেন দলের প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক।

ইন্তেরনাসিওনালের মূল দলের হয়ে প্রায় চার মৌসুম খেলেছিলেন অ্যালিসন বেকার। দলটির হয়ে ৫৮ ম্যাচে অংশগ্রহণ করেছিলেন এই ব্রাজিলিয়ান। এসময় ইউরোপীয় বড় দলগুলোর নজরে আসে এই প্রতিভাবান গোলরক্ষক। ট্রান্সফার মার্কেটে বাকি প্রতিযোগিদের হারিয়ে ২০১৬–১৭ মৌসুমে প্রায় ৮ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ইতালীয় ক্লাব রোমা কিনে নেয় তরুণ অ্যালিসন বেকারকে।

রোমাতে মাত্র দুই মৌসুম খেলেই পুরো ফুটবল বিশ্ব তার নাম ছড়িয়ে যায়। বিশেষ করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে লিওনেল মেসির বার্সেলোনার বিপক্ষে সেই রোম কাব্যের পর অ্যালিসন হয়ে উঠেন আরো জনপ্রিয়। সবমিলিয়ে ইতালিয়ান ক্লাবটির হয়ে ৬৪ ম্যাচ খেলে ২৬টি ক্লিনশিট রেখেছেন তিনি, গোল হজম করেছেন ৬৬ টি।

ব্রাজিলের এই তারকার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখে এএস রোমা থেকে রেকর্ড ট্রান্সফার ফি-তে লিভারপুলে উড়িয়ে নিয়ে আসা হয় অ্যালিসনকে। ১২ই আগষ্ট ২০১৮ সালে ওয়েস্ট হামের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে অলরেড জার্সিতে অভিষেক হয় এই গোলরক্ষকের। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।

অ্যালিসন বেকার লিভারপুলের হয়ে সম্ভাব্য সব ট্রফি জিতে নিয়েছেন। ফুটবল ইতিহাসে প্রথম গোলরক্ষক হিসেবে এক মৌসুমেই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ গোল্ডেন গ্লাভস, চ্যাম্পিয়নস লিগ গোল্ডেন গ্লাভস, উয়েফার বর্ষসেরা গোলরক্ষক, ফিফা বর্ষসেরা গোলরক্ষক, গোলরক্ষকদের ব্যালন ডি’অর খ্যাত ‘লেভ ইয়াসিন’ পুরস্কার অর্জনের ঝুলিতে যোগ করেছিলেন অ্যালিসন।

এছাড়া দলীয় শিরোপা হিসেবে জিতেছেন উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ক্লাব বিশ্বকাপ, প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা, উয়েফা সুপার কাপ, এফএ কাপ এবং লিগ কাপ। এখন পর্যন্ত ইয়ুর্গেন ক্লপের দলের হয়ে ১৯৩ ম্যাচ খেলেছেন তিনি, এর মাঝে ৮৮ ম্যাচে হজম করেননি কোন গোল।

জাতীয় দল ব্রাজিলের হয়েও সদা উজ্জ্বল অ্যালিসন বেকার। ২০১৫ সালে প্রথমবার দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি, এরপর অনেকবারই সেলেসাওদের আভিজাত্য রক্ষার প্রতিজ্ঞায় প্রাচীয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ২০১৯ সালে আন্তঃমহাদেশীয় টুর্নামেন্ট কোপা আমেরিকার শিরোপা হাতে উঠেছিল তাঁর।

ক্যাসিয়াস লরিসের ভুলে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে পারেনি লিভারপুল; তিন দশক ধরে লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পায়নি তারা। অন্যদিকে ব্রাজিল শিরোপা জেতেনি ছয় বছর, এই সব অপ্রাপ্তি এক লহমায় পূর্ণ করেছেন অ্যালিসন বেকার৷ ক্লাব কিংবা জাতীয় দল বাজ পাখির মতই আরাধ্য সব ট্রফি ছিনিয়ে নিয়ে এসেছেন তিনি।

ক্যারিয়ারে শুধুই একটি অপূর্ণতা আছে ব্রাজিলিয়ান সেনসেশনের। ক্যাবিনেটে একটা ট্রফি যোগ করা বাকি এখনো, সেটি বিশ্বকাপ। একটি বিশ্বকাপই অ্যালিসনের ক্যারিয়ারকে পূর্ণতা দিবে। অনেকটা সময় বাকি এখনো, কাতারে কিংবা অন্য কোথাও হয়তো ঠিকই বিশ্বকাপ হাত উঠবে তাঁর।

অবশ্য বিশ্ব জয়ের স্বাদ না পেলেও কিছু আসে যায় না, এখন পর্যন্ত যা অর্জন করেছেন অ্যালিসন বেকার তাতেই তিনি এখন কিংবদন্তি তুল্য। আজ থেকে কয়েক প্রজন্ম বাদে ভক্তদের কোনো আসরে যদি বার্সেলোনার বিপক্ষে লিভারপুল কিংবা রোমার কামব্যাক নিয়ে আলোচনা হয়, নিশ্চিতভাবেই স্মৃতির পাতার মলাট খুলতেই ইতিহাস খুঁজে নেবে এই অ্যালিসনকে।

স্মৃতিতে ভেসে উঠবে অ্যালিসন বেকারের রূপকথা। আর এমন ফর্মের ধারবাহিকতা ধরে রাখলে নি:সন্দেহে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছড়িয়ে যাবে একজন বেকারের গল্প; অ্যানফিল্ডের সবুজ ঘাসে নিবেদিত এক প্রাচীরের গল্প।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link