সিডনিতে গতকাল ভারতের বিপক্ষে অনুশীলন ম্যাচে একটা সেঞ্চুরি করেছেন অস্ট্রেলিয়া-এ দলের ব্যাটসম্যান বেন।
খুবই অর্থহীন সেঞ্চুরি। এই সেঞ্চুরির পরও ম্যাচ ড্র হয়েছে। তাই সেঞ্চুরিটা কেউ মনে রাখবে না। এমনিতেও এসব সেঞ্চুরি কে মনে রাখে? দুনিয়ার নানা প্রান্তে কতো প্রথম শ্রেনীর ম্যাচ, অনুশীলন ম্যাচ হচ্ছে। তাতে কতো ব্যাটসম্যান এরকম সেঞ্চুরি করছেন। সব নিয়ে কী উচ্ছাস করা যায়?
আপনি, আমি না করতে পারি। কিন্তু একজন মানুষের জন্য এই সেঞ্চুরিটার বিশেষ একটা দাম আছে।
গোল্ড কোস্টে নিজের বাড়িতে বসেই সম্ভবত বেনের খেলা দেখছিলেন সেই ভদ্রলোক। বেন একটু একটু করে সেঞ্চুরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। সেঞ্চুরিটা হয়ে যাওয়ার পর নিশ্চয়ই দু হাত ওপরে তুলে বলেছেন, ‘সাবাশ, বাপকা বেটা।’
হ্যা, বেন তার বাবারই উপযুক্ত ছেলে। বেন হলেন সেই ক্রেইগ ম্যাকডারমটের ছেলে; বেন ম্যাকডারমট।
ম্যাকডারমট নামটা শুনলে ভারতীয় সমর্থকদের মনে একটা ঘৃণা তৈরী না হয়ে যারে না। ১৯৯১-৯২ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরে এই ম্যাকডারমট একেবারে ধ্বসিয়ে দিয়েছিলেন ভারতীয় ব্যাটিংকে। বলা যায়, এক হাতে গুড়িয়ে দিয়েছিলেন এই ফাস্ট বোলার। প্রায় তিন দশক পর সেই ভারতকে পেয়ে এবার সেঞ্চুরি তুলে নিলেন ছেলে বেন ম্যাকডারমট; হোক অনুশীলন ম্যাচের সেঞ্চুরি।
আগে ক্রেইগের গল্পটা শুনে আসি।
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ৭১ টেস্ট ও ১৩৮ ওয়ানডে খেলা ক্রেইগ ম্যাকডারমট আশির দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার প্রধাণতম ফাস্ট বোলার ছিলেন। ১৯৮৭ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেট শিকার। যদিও ইনজুরি আর অন্যান্য সমস্যা মিলিয়ে শুরুর মতো এক্সপ্রেস বোলার আর ছিলেন না। কিন্তু দারুন কার্যকর ফাস্ট বোলার ছিলেন।
২৯১ উইকেট নিয়ে তিনি অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তী বিশেষ। কিন্তু ম্যাকডারমটের একটা আফসোস ছিলো, ভারতের বিপক্ষে ভালো করতে না পারা। এই দলটির বিপক্ষে ১৯৮৫ সালে এডিলেডে প্রথম টেস্ট খেলেছিলেন; প্রথম ইনিংসে ৩ উইকেট নিয়েছিলেন। এরপর ভারতের বিপক্ষে টানা ৫ ইনিংস কোনো উইকেট পাননি। সম্ভবত ১৯৯১-৯২ সালের সেই বিখ্যাত সফরের জন্য জমিয়ে রেখেছিলেন।
এই সফরের শুরুতেই ব্রিসবেনে প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট নিলেন। ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হলেন। এরপর এডিলেডে আজাহারউদ্দিনের জীবন বাচানো সেঞ্চুরিকেও ম্লান করে দিলেন ১০ উইকেট নিয়ে। আবার ম্যাচসেরা! সিরিজের ৫ ম্যাচে ম্যাকডারমট ৩১ উইকেট নিয়ে হলেন সিরিজ সেরা খেলোয়াড়। এ ছাড়া পাশাপাশি ওয়ানডে সিরিজটাতেও দূরন্ত বল করেছিলেন। সবমিলিয়ে ভারত তার তখন ‘প্রিয় দল’।
খেলা ছাড়ার পর কোচিং করিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার সেন্টার অব এক্সলেন্সে তার হাত ধরেই উঠে এসেছেন মিশেল স্টার্ক, জশ হ্যাজেলউড ও জেমস প্যাটিসন। তিন জনই অস্ট্রেলিয়ার হয়ে দূরন্ত বল করে ম্যাকডারমটের নাম উজ্জল করেছেন। কিন্তু নিশ্চয়ই স্বপ্ন ছিলো যে, ছেলেরা কেউ অস্ট্রেলিয়ার হয়ে এমন দূরন্ত বোলিং করবেন।
সেই স্বপ্নটা পূরণ করার পথে ছিলেন অ্যালিস্টার ম্যাকডারমট। বাবার মতোই দূরন্ত ফাস্ট বোলার ছিলেন। স্কুল পার হওয়ার আগেই অস্ট্রেলিয়াতে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। স্কুলে থাকতে কুইন্সল্যান্ডের চুক্তিভূক্ত খেলোয়াড় হয়েছিলেন। একেবারে পরিষ্কার ছিলো যে, ক্রেইগ ম্যাকডারমটের নাম রাখবেন অ্যালিস্টার। কিন্তু কিছু ইনজুরি আর ফর্মহীনতা একেবারেই ছিটকে দিলো অ্যালিস্টারকে। ২০১৫ সালের পর থেকে আর গুরুত্বপূর্ন ক্রিকেটে নেই বললেই চলে। ধিকি ধিকি করে এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে জাতীয় দলের স্বপ্নটা ফিকে হয়ে গেছে অনেক আগেই।
অ্যালিস্টারের এই পরিণতি দেখে ভেঙে পড়ার কথা ক্রেইগের। কারণ ছোট ছেলেটা তো বাবার পথেই হাটেনি; তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবেন কী করে!
বাবা, বড় ভাই যেখানে এমন ব্যাটসম্যান কাপানো ফাস্ট বোলার ছিলেন, ছোট ছেলে বেন হয়েছেন ব্যাটসম্যান! এই ছেলের জন্য কী বাজি রাখা যায়? এই ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়?
হ্যা, যায়। কারণ, এই বেনই শেষ পর্যন্ত বাবার পথ ধরে অস্ট্রেলিয়া জার্সি শরীরে চড়িয়েছেন। বড় ভাইয়ের ক্যারিয়ার যখন শেষের দিকে, সেই ২০১৩ সালের দিকে বেন বিগ ব্যাশে ডাক পেয়ে গেলেন। এরপর দূরন্ত পারফরম্যান্স। ব্যাটে ঝড় তুলে অস্ট্রেলিয়া দলে চলে এলেন। ২০১৮ সালে জাতীয় দলে ডাকও পেলেন। দেখতে দেখতে ১২টা টি-টোয়েন্টি খেলে ফেলেছেন। খুব বড় কিছু এখনও করেননি। তবে সম্ভাবনা আছে দারুন।
বেন তাহলে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চলেছেন?
বেনকে নিয়ে বাবা হয়তো গর্ব করবেন, হয়তো ছেলের গল্প করে বেড়াবেন। কিন্তু স্বপ্নপূরণ? সে হবে না। কারণ, বেন তো শখের বসেও বল করেন না। ব্যাটিংয়ের বাইরে তিনি মাঝে মাঝে উইকেটকিপিং করেন; বোলিং নয়!