নতুন এক অর্জন। নায়কটা পুরনো। ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মত দুইটি ভিন্ন বিশ্বকাপ শিরোপা একই সময়ে নিজেদের দখলে নেওয়া দলটার নাম ইংল্যান্ড। আর আশ্চর্যজনকভাবে দুই ক্ষেত্রেই তাদের জয়ের নায়ক একজন বেন স্টোকস। তাঁর বদৌলতেই ২০১৯ বিশ্বকাপটা ঘরের মাঠে নিজেদের করে নিয়েছিল ইংলিশরা। বছর তিনেক বাদে অজিদের মাটিতে ইংলিশদের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শিরোপা উৎসব।
অবশ্য, এই নায়ক ২০১৬ সালেও খলনায়কই ছিলেন। কার্লোস ব্র্যাথওয়েটের সেই একটা ঝড় ক্রিকেটের ইতিহাসের পাতায় যেমন উঠেছিল – তেমনি খলনায়ক বনে গিয়েছিলেন বেন স্টোকস। কত অসংখ্য রাত সেই শেষ ওভারটা কাঁদিয়ে গিয়েছে তাঁকে – সেই খোঁজ কে নিয়েছে কবে। কিন্তু, বিধাতা অবশেষে ওয়ানডের পর টি-টোয়েন্টিতেও মুখ ফিরে চাইলেন তাঁর দিকে।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বিচারে বেন স্টোকস বেশ সাদামাটা গোছের একজন খেলোয়াড়। অন্তত তাঁর পরিসংখ্যান সে কথাই বলে। তবুও বর্তমান সময়ে অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হিসেবেই বিবেচিত হন বেন স্টোকস। তিন ফরম্যাটেই তিনি ইংল্যান্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে প্রচণ্ড চাপের কথা মাথায় রেখে তিনি বিদায় জানিয়েছেন ওয়ানডে ক্রিকেটকে। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে তিনি সর্বোচ্চ অর্জন নিজের করে ফেলেছেন। বাকি দুই ফরম্যাটেই তিনি নজর দেবেন তেমন আভাসই পাওয়া যাচ্ছিল।
সে মোতাবেক ইংল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দল বেন স্টোকসের অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত স্বাভাবিক। তবুও এবারের বিশ্বকাপে তিনি কোন প্রকার আলোড়ন সৃষ্টি করতেই যেন পারছিলেন না। ব্যাট ও বল হাতে গড়পরতা মানের পারফরমেন্স তিনি করে যাচ্ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে দল নিশ্চয়ই গড়পরতা মানের পারফরমেন্স প্রত্যাশা করে না। তিনি নিজেও সেটা জানেন।
পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে নিজেকে প্রমাণ করতে তিনি তবুও হয়েছেন ব্যর্থ। তাতে কি? স্টোকস একজন চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার। চ্যাম্পিয়ন মানসিকতা তাঁর মধ্যে বিদ্যমান। তিনি জানেন দলের সবচেয়ে কঠিন সময়টাতে চাইলেই তিনি হয়ে যেতে পারবেন ত্রাতা। তেমনই আরেকটা উদাহরণ সৃষ্টি করলেন স্টোকস। নিন্দুকদের আরেকটু ধৈর্য্য ধরতেই যেন বলে গেলেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে। কি অনবদ্য! কি দুর্দান্ত এক ইনিংস! দলকে একা হাতে আগলে রেখে নিয়ে গেলেন জয়ের বন্দরে।
১৯৯২ সালের হুবহু মঞ্চায়ন। সেবার টসে জিতে পাকিস্তান শেষমেশ শিরোপাও জিতে নিয়েছিল। সেই বিশ্বকাপের প্রতিশোধে এমন কাকতালীয় মঞ্চ আর তো মিলবে না। টস ভাগ্য ইংল্যান্ডে পক্ষে। তবে ম্যাচের ফলাফলটা নিজেদের করে নিতে হলে ইংল্যান্ডের খেলা চাই দুরন্ত এক ম্যাচ। টস জিতে বোলিং করবার সিদ্ধান্ত নেন জস বাটলার। ইংলিশ বোলাররা কঠিন চাপে ফেলে দেয় পাকিস্তানি ব্যাটারদের। ব্যাস! শিরোপা জয়ের কাজটা খানিক সহজই হয়ে যায়।
মাত্র ১৩৮ রানের টার্গেট পায় ইংল্যান্ড। ওপেনারদের ফর্ম বিবেচনায় এ তো মামুলি টার্গেট। তবে প্রতিপক্ষ বোলিং আক্রমণ তো বিধ্বংসী। তাদের বিপক্ষে সহজে জয় পাওয়াটা বড্ড কঠিন। পাকিস্তানের পেস আক্রমণ তো বিশ্ব নন্দিত। সে আক্রমণ ঠিক কতটা ভয়ানক হতে পারে সেটার প্রমাণ তো পেয়েছে ইংল্যান্ডের ব্যাটাররা। একটা সময় এই মামুলি লক্ষ্যও বহু দূরের পথ মনে হতে শুরু করে। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে শুরু করে ইংল্যান্ড। তবে একটা প্রান্ত আগলে ধরে রাখেন বেন স্টোকস।
নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম টি-টোয়েন্টি অর্ধ-শতক তুলে নেন স্টোকস। এই একটা তথ্যও নিশ্চয়ই স্টোকসের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের সারমর্ম। তবে এসব কিছুই আসলে কোন মূল্য রাখে না। তাঁর করা ধীরস্থির গতির ৫২ রানই দলকে নিয়ে গিয়েছে জয়ের বন্দরে। তিনি পাকিস্তানের বোলারদের যথাযথ সমীহ করেছেন। উইকেট আর পরিস্থিতি বুঝে তিনি ব্যাটিং করেছেন। অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি একটি বারও নেননি। ইনিংসের দ্বাদশ ওভারে নাসিম শাহের প্রতিটা বল ব্যাট ঘেসে বেড়িয়ে গিয়েছে। তিনি ওভারটা দেখে খেলেছেন। উইকেট বিলিয়ে দেননি।
স্নায়ু চাপ ধরে রেখে তাঁর খেলা এই দায়িত্বশীল ইনিংসে ২০১০ সালের পর আবারও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শিরোপাটা নিজেদের করে নিল ইংল্যান্ড। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে যৌথভাবে এখন সর্বোচ্চ চ্যাম্পিয়ন ইংলিশরা। বেন স্টোকস নিজের স্মৃতির ঝুলিতে আরও একটি ইনিংস বাগিয়ে নিলেন। ইংল্যান্ডের সমৃদ্ধ ক্রিকেট ইতিহাসে আরও একবার বিশাল জায়গা দখল করে নিলেন। স্টোকস সত্যিকার অর্থেই ‘বিগ ম্যাচ প্লেয়ার’।
২০১৬’র ফাইনালে ইয়ান বিশপ বলেছিলেন, ‘কার্লোস ব্র্যাথওয়েট, রিমেম্বার দ্য নেম।’ সেই ব্র্যাথওয়েট হারিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু, সেদিনের ভিলেন স্টোকস হারিয়ে যাননি। তিনি ফিরেছেন বারবার, নানা ভাবে, নানা ফরম্যাটে, বড় বড় সব ম্যাচে। ফিনিক্স পাখিরা এভাবেই ফিরে আসে।