বেন্ড, বেন্ড, বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম!

১.

গ্যারি নেভিলের পাশে একটা সাদা তোয়ালে গায়ে দিয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়েছেন ব্রিটিশ ফুটবলের উঠতি পোস্টারবয়। বিয়ারের মগে চুমুক নিচ্ছেন নেভিল। স্যুইটে নিজেদের বিছানায় টিভিতে মগ্ন দুজনে। একটু আগেই হোটেলের লাউঞ্জে ডেভিড বেকহ্যামকে দেখা যাওয়ার খবর পেয়ে ব্রিটিশ গার্ল আর পাপারাজ্জিদের ভিড়ে চুড়ান্ত বিশৃঙ্খলা হয়ে গেছে। কোনোমতে সেই ভিড় থেকে বেকস-কে বের করে আনতে রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছে পুলিশকে।

এক নারী তো ‘ম্যারি মি বেকস’ লেখা পোস্টার নিয়ে রীতিমতো হামলা করেছেন। ব্রিটিশ ফুটবল দলের ম্যানেজার বুঝে গেছেন বেকহ্যামকে কোথাও আওয়ে ম্যাচে নিয়ে যেতে হলে নারীমহলকে সামলানোর জন্য আলাদা পুলিশি প্রহরা দরকার।

‘ওই মেয়েটাকে দেখছ? মাঝের জন। আমার ওকে চাই…’

থতমত খেয়ে গেলেন নেভিল। যে ছেলের জন্য পুরো ইংল্যান্ড পাগল হয়ে আছে তার মন কে জিতে নিল এভাবে? টিভিতে স্পাইস গার্লের শোতে মাঝের মেয়েটির দিকে তাক করে আছে বেকসের তর্জনী।

লক্ষ্যভেদে তিনি বরাবরই সফল যে!

২.

চেলসির সাথে ম্যাচ শুরু হতে কয়েক মিনিট বাকি। স্যার অ্যালেক্সের কড়া নজরে ম্যান ইউ ফুটবলাররা। বেকস নিজের চুলের কসরতি সেরে টানেল দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে থমকে গেলেন। ভিক্টোরিয়ার চোখে চোখ পড়তেই যেন পা দুটো অসাড় হয়ে গেল তাঁর,অথচ এই দুটো পায়েই আজ চেলসি বধের মহড়া কষেছেন অ্যালেক্স।

ডেভিডকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাত নাড়লেন ভিক্টোরিয়া, সুপারস্টার বেকহ্যাম – যাঁর জন্যে মেয়েদের একটি বিশেষ অপেক্ষাগৃহ বানানোর পরিস্থিতি হয়েছিল ওল্ড ট্রাফোর্ডে সেই বেকহ্যাম হোঁচট খেলেন, একেবারে ম্যাচ শুরুর আগে ভিক্টোরিয়ার হাতনাড়া দেখে ধপাস করে বসে পড়লেন রিজার্ভ বেঞ্চে। ম্যাচে নামছেন বেকস। উত্তাল জনতা, এদিকে তার চোখ খুঁজে চলেছে ভিক্টোরিয়াকে – যেন মফ:স্বলের কোচিং ক্লাসের মাধ্যমিকের বাধ্য ছেলে খুঁজছে তাঁর প্রথম প্রেমকে, কিন্তু আসলে অমন চাহনি ক্যাবলা করে দিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ফুটবলারকে!

খেলার পর কথা রাখলেন ভিক্টোরিয়া, সেই প্রথম কথার শুরু – বেকস কথা রাখলেন- ‘ঐ মেয়েটাকে আমার চাই…’।

বেকস ভিক্টোকে আগলে রাখলেন ২৩ টা বছর- বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল সুপারস্টারের জীবনে চিরবসন্তের মতো এল প্রেম – সে প্রেমের দোলাও লাগল বেকসের খেলায়! সালটা ছিল ১৯৯৭৷  তার পরের কটা বছর বেকহ্যাম খেললেন- গ্যালারি থেকে সবটুকু ইতিহাসের সাক্ষী থাকলেন তাঁর স্ত্রী।

আর কি আশ্চর্য জর্জ বেস্ট-এরিক ক্যান্টোনার ঐতিহাসিক ৭ নম্বর জার্সিটা আলেক্স তুলে দিলেন ২৩ বছরের ছেলেটার গায়ে- ঐ-ঐ বছরেই!

৩.

‘বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম’ – ১৯৯৯-এর সেই ফাইনালে এক গোলে পিছিয়ে রেড ডেভিলরা। বায়ার্নের ঝড় আছড়ে পড়ছে বারে বারে। ইনজুরি টাইমে দুটো কর্ণার রাখলেন বেকহ্যাম – দুটো গোল!

এই আশ্চর্য ইতিহাসের ধাক্কায় ট্রেবল যেমন এল ম্যান ইউ তাঁবুতে তেমনই পল স্কোলস আর রয় কিনের অনুপস্থিতিতে বেকহ্যামের ম্যাজিক লালদূর্গে একটা নিশান বেঁধে দিল – ‘ওয়ান সান, ওয়ান মুন অ্যান্ড ওয়ান বেকহ্যাম!’

এরপর তো এক স্কোরবোর্ডের ইতিহাস। সেখানে ডানদিক থেকে একটা করে দৌড় ফালা ফালা করে দিল বিপক্ষ রক্ষণ, বাঁক খাওয়া ফ্রি কিক যতবার জাল কাঁপিয়েছে ততবার ঢেউ লেগেছে লাল গ্যালারিতে, তবে বেকহ্যাম দিনের শেষে কত বড় মাপের ফুটবলার তার স্ট্যাটিস্টিকাল আলোচনার চেয়েও বেশি আলোচনা হওয়া দরকার অন্য একটি বিষয়ে!

৬ বছর বয়সে তাঁকে একবার স্কুলে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- ‘তুমি কী হতে চাও?’

‘ফুটবলার’

‘হ্যাঁ, আমি জানি তুমি ফুটবল ভালোবাসো, কিন্তু এমনিতে কী হতে চাও? ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার নাকি বিজনেসম্যান?’

‘ফুটবলার, ফুটবলার এবং ফুটবলার…’

 

ছয় বছরের ছেলের এমন জবাবে চমকে গেছিলেন ক্লাসটিচার। বেকহ্যাম ফুটবলের রোম্যান্সের আগেও বিশ্বের গালিচায় লিখেছেন অদম্য মানসিকতার উপন্যাস। তিনি জেদের বশে লড়েছেন, নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন, ঈশ্বর ও তাঁকে দিয়েছেন দুহাত ভরে, কি প্রেম কি ফুটবল কি দলবদল!

ইংল্যান্ড থেকে স্পেনে পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস সহজ নয়, হয়ত বেকহ্যাম এই চ্যালেঞ্জটাও নিয়েছিলেন নিজের দৃঢ় মানসিকতা দিয়ে আর তাতেও তিনি দুশোভাগ সফল- ঠিক এখানেই বেকহ্যামের বেকহ্যামত্ব মাঠ ছাড়িয়ে বেড়িয়ে যায় অনেক দূর, ‘I never thought anything negative, If I need to work hard to be positive I will do the same!’

বেকহ্যামকে কোনোদিন নিজের বিজ্ঞাপন করতে হয়নি, বেকহ্যাম দৌড়েছেন নিজের ট্র‍্যাকে, সাফল্য আর জনপ্রিয়তা তাকে ধাওয়া করেছে – এখানেই পৃথিবীর শেষ টাচলাইনে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন- যিনি দু পায়ে দু রঙা জুতো পড়লে সেটাই ট্রেন্ড হয়ে যায় ইউরোপে,যেখানে তাঁর নতুন চুলের কায়দা ইউরোপের সেলুনে ভিড় বাড়িয়ে দেয়, যেখানে বেকহ্যামের একটা অটোগ্রাফের জন্য সারারাত লাইনে দাঁড়াতে পারে ভক্তরা – স্টার স্টার এবং সুপারস্টারেষু হয়ে ওঠার মার্গ বেকহ্যাম নিজেই এঁকেছেন, নিজেই সে পথে পৌঁছেছেন এমন উচ্চতায় যেখানে দুহাত মেলে তিনি বলতে পারেন- আমি এটা করেছি!

নিজের শরীরে অনেকগুলো অধ্যায়ের থেকে একেবারে আলাদা করে সেদিনের সেই ক্যাবলা হয়ে যাওয়া সুপারস্টার তাঁর প্রিয়তমার নামখানা খোদাই করেছেন সুদূর ভারতের একটি ভাষায়- বেকহ্যামের জীবনের সমস্ত জৌলুস যে মেয়েটি যত্ন করে আগলাচ্ছে এতগুলো বছর।

সেই প্রেম, সেই ১৯৯৮-এর সকাল, সেই ৭ নম্বর জার্সি আর তারপর এক একটা বাঁক খাওয়া সেন্টার।

হে ফুটবল, জীবন আর সবুজ গালিচার এত ম্যাজিকাল কার্ভ আর পাবে না তুমি।

সুপারস্টারকে তাই আরও একবার – বেন্ড, বেন্ড, বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link