কেমন হয় যদি কার্ল মার্কস দক্ষিণপন্থী হয়ে যান? আঁতকে উঠলে চলবে না! সত্তরের দশকে বিখ্যাত ব্রিটিশ কমেডি দল মন্টি পাইথন ‘দ্য ফিলোসফারস ফুটবল ম্যাচ’ বা দার্শনিকদের ফুটবল ম্যাচ নিয়ে একটি স্কেচ উপস্থাপনা করে যাতে হাফটাইমের পরে জার্মান দার্শনিকদের নিয়ে গঠিত ফুটবল দলের হয়ে ডান প্রান্ত বরাবর খেলতে নামেন কার্ল মার্কস।
তবে, সিরিয়াস রাজনৈতিক দর্শনের এরকম ভয়াবহ ‘বিবর্তন’ যে ঘটেনি তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু মন্টি পাইথনের কল্পিত এই বিশেষ দৃশ্যের প্রতিফলন দেখা গিয়েছে ফুটবলের দর্শনে! আধুনিক ফুটবলের বিবর্তনকে পড়তে গেলে এক বিশেষ টার্মিনোলজিকে বাদ দিয়ে পড়া যাবে না। সেটি হল ‘ইনভার্টেড উইঙ্গার’। কেমন সেই ব্যাপারটা? জানতে গেলে আগে একটু ‘উইঙ্গার’ বিষয়টির দিকে চোখ রাখতে হবে।
ফুটবল মাঠের দুই সাইডলাইন বা প্রান্ত বরাবর অংশকেই উইং বলা যেতে পারে। এখন, এই প্রান্ত ধরে যাঁরা খেলেন তাঁদের উইঙ্গার বলা যাবে কি না তা নির্ভর করছে কীরকম সিস্টেমে খেলা হবে তার ওপরে। যেমন, ষাটের দশক কিংবা সত্তরের দশকে ব্যাক বা রক্ষণভাগের খেলোয়াড়েরা উইং ধরে উঠে বিপক্ষের বক্সে ক্রস করতেন কিংবা গোল করার পরিস্থিতিও তৈরি করতেন (ওভারল্যাপিং সাইড ব্যাক হিসেবে ব্রাজিলের কার্লোস আলবার্তোর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য)।
আবার, ৩-২-৫ কিংবা ৪-২-৪ ছকে খেলার সময়ে ওয়াইড/আউটসাইড ফরোয়ার্ড হিসেবে উইঙ্গাররা খেলতেন, তাঁরা আক্রমণ বিভাগেরই খেলোয়াড়। যেমন, ভারতেরই পিকে ব্যানার্জি। এছাড়াও ব্রাজিলের গ্যারিঞ্চা কিংবা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জর্জ বেস্ট এঁরা প্রান্ত দিয়ে খেলতে খেলতে ভেতরে ঢুকে এসে বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে পৌঁছে যেতেন ব্যক্তিগত মুন্সিয়ানার মাধ্যমে। সত্তরের দশকে জার্মানির এক খেলোয়াড়ও প্রান্ত বদলে খেলতেন। পরবর্তীকালে রবার্তো কার্লোস থেকে শুরু করে অধুনা ট্রেন্ট আলেকজান্ডার আর্নল্ডের মত উইংব্যাকদের নিদর্শন চোখে পড়ার মত।
ফুটবল যত বেশি সিস্টেম-নির্ভর হয়েছে ততই ‘স্পেশালাইজড পজিশন’-এর ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে জনপ্রিয় হওয়া ৪-৪-২ ছকে উইঙ্গারদের বিশেষ ভূমিকা নির্ধারিত হল। এখানে উইঙ্গার হলেন মাঝমাঠের খেলোয়াড়। বাঁ-পায়ের খেলোয়াড় বাঁ-প্রান্তে আর ডান পায়ের খেলোয়াড় ডান-প্রান্তে খেলবেন, এঁরা আক্রমণ ভাগের দুই ফরোয়ার্ডকে প্রান্ত থেকে বল সাজিয়ে দেবেন গোল করার জন্য।
বাঁ-পায়ের খেলোয়াড় বাঁ-প্রান্তে বল ধরে বক্সে ক্রস রাখবেন, ডান প্রান্তের খেলোয়াড় ঠিক অন্য দিক দিয়ে একই কাজ করবেন। এঁদের সাইডলাইনের ধারে নিজেদের শক্তিশালী পায়ে বল-নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা খুব ভাল। বিপক্ষের সাইডব্যাকদের এঁরা ব্যস্ত রাখবেন সবসময়। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে স্যর আলেক্স ফার্গুসনের অধীনে রায়ান গিগস ও ডেভিড বেকহ্যাম এই সিস্টেমে দুই আদর্শ উইঙ্গারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
নতুন শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই আবার ‘স্পেশ্যালাইজড পজিশন’ নিয়ে নাক কোঁচকাতে শুরু করলেন আধুনিক কোচেরা। ওটুকুতে তাঁরা সন্তুষ্ট নন। ফুটবলে ততদিনে সবচেয়ে জরুরি টেকনিক্যাল কথা হয়ে উঠেছে ‘স্পেস’ বা মাঠের মধ্যে খেলার প্রয়োজনে ব্যবহারযোগ্য পরিসর। বিপক্ষ দলের জন্য স্পেসকে কতভাবে সঙ্কুচিত করা যায় আর নিজের দলের জন্য স্পেসকে কীভাবে প্রসারিত করা যায় – সহজ কথায় এই মোটামুটি ভাবনা।
এই বিশেষ প্রয়োজন থেকেই ‘স্পেশ্যালাইজড রোল’-এর ধারণার জন্ম। তাহলে এতদিন যাঁরা নির্দিষ্ট পজিশনে খেলে নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করলেন তাঁদের সঙ্গে এই ভূমিকার পার্থক্য কী? এই বিশেষ রোলে উঠে এল একসঙ্গে বহু পজিশনের প্রয়োজন মেটানো কিংবা বহু রোল পালন করার বিষয় – স্পেশ্যালাইজড রোল আসলে মাল্টিফাংশনাল। চেলসিতে হোসে মোরিনহোর হাত ধরে ক্লদিও ম্যাকেলেলে যেমন ‘ম্যাকেলেলে রোল’ – এর জন্ম দিলেন। একই সঙ্গে সেন্ট্রাল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার, বক্স টু বক্স এবং লিবেরো – এত রকম পজিশন ও রোলের ধন্দ কাটল অনেকটা।
এই মোরিনহোর প্রশিক্ষণাধীন চেলসিতেই ২০০৪-০৫ মৌসুমে যোগ দিলেন প্রতিভাবান ডাচ খেলোয়াড় আরিয়েন রবেন। হল্যান্ডের পিএসভি আইন্দোভেন থেকে। লেফট মিডফিল্ডার কিংবা প্রথাগত লেফট উইঙ্গার হিসেবেই এই বাঁ পায়ের খেলোয়াড়ের খেলে আসা। চেলসিতেও সেই রোলে ভেবেই তাঁকে আনা হল।
এতদিনে ওই পজিশনে খেলে আসা বাঁ পায়ের ড্যামিয়েন ডাফকে ডানদিকে সরিয়ে রবেনকেই বাঁ দিকে শুরু করালেন হোসে মরিনহো। খুব সামান্য সংখ্যক ম্যাচেই এর অন্যথা ঘটল, খেলার মাঝে প্রান্ত পরিবর্তন করে মাঝেমাঝে খেলতে দেখা গেল দ্রুতগতির, সহজাত ড্রিবলিংয়ে পারদর্শী রবেনকে। কিন্তু চেনা ছবিটা পাল্টাল ক্লাব ছাড়ার পরে।
ফুটবলের দুনিয়ায় এগিয়ে থাকা দেশগুলোর যেসব প্রশিক্ষক সিস্টেম-নির্ভর খেলাকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন তাঁদের অধিকাংশই নেদারল্যান্ডস, জার্মানি কিংবা ইতালির এবং প্রচলিত ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে গিয়ে কিছুটা আর্জেন্টিনারও। রিয়াল মাদ্রিদ যোগ দিয়ে রবেন পেলেন জার্মান প্রশিক্ষক বার্নড শুস্টারকে। বাঁ-পায়ের খেলোয়াড় রবেনকে শুস্টার নিয়মিত ভাবে শুরু করালেন ডান প্রান্তে। রাইট উইঙ্গার হিসেবে।
এখানেই প্রযোজ্য ‘ইনভার্টেড উইঙ্গার’ – এর ধারণা। সহজাত বাঁ পায়ের লেফট উইঙ্গার চলে এলেন প্রায় প্রথাগত রাইট উইঙ্গারের পজিশনে। কিন্তু না, ৪-৪-২ সিস্টেমজাত উইঙ্গারেরা যেখানে ছিলেন আদতে ওয়াইড মিডফিল্ডার, এখানে রাইট উইঙ্গার হয়ে গেলেন ফরোয়ার্ড পজিশনের অংশ। অর্থাৎ, পজিশন ও রোল দুইয়েরই বদল ঘটল। এই ইনভার্টেড উইঙ্গার প্রান্ত বরাবর সোজা ছুটে শক্তিশালী পায়ে বক্সে ক্রস করবেন না, অন্তত প্রাথমিক ভূমিকা সেটা হবে না।
বরং, কাট করে ভেতরে ঢুকবেন, গোলে শট নেবেন শক্তিশালী পায়ে, ব্যস্ত রাখবেন বিপক্ষের সাইডব্যাক থেকে সেন্টার ব্যাক সবাইকেই। দৌড়ের ধরন হবে মূলত ল্যাটারাল। এর ফলে বেশ কয়েকটা সুবিধা মিলবে। একদিকে যেমন নিজের দলের একক সেন্টার ফরোয়ার্ডের সঙ্গে খানিক পেছন থেকে তিনি যোগাযোগ রাখবেন, নিজে প্রান্ত ছেড়ে ভেতরে ঢুকে এসে ‘ইনসাইড ফরোয়ার্ড’ – এর মত ভূমিকা পালন করবেন তেমনই নিজের দলের প্রান্ত ধরে উঠে আসা উইংব্যাক মারফত আক্রমণের জন্য অনেকটা জায়গা বা স্পেস তৈরি করে দেবেন।
তাঁর জন্যই উঠে আসার সুবিধা পাবেন নিজের দলের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়। ফলে আক্রমণের সময় বিপক্ষের বক্সের কাছে লোকসংখ্যা বাড়বে। রবেন ডানদিক থেকে এগুলোই করতে শুরু করলেন। ২০০৯-এ জার্মানির বায়ার্ন মিউনিখে যোগ দিয়ে কোচ হিসেবে পেলেন কিংবদন্তি লুই ফান গালকে। স্পেস নিয়ে সেই নব্বইয়ের প্রথম ভাগ থেকেই কাটাচেরা করা এই দার্শনিক কোচ একই ভাবে ব্যবহার করতে শুরু করলেন রোবেনকে।
২০১০ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের ফান মারউইকও ব্যবহার করলেন একই ভাবে। বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠল নেদারল্যান্ডস। ফাইনালে রবেনের সামনে গোল করার দুটো সুবর্ণ সুযোগ এলেও স্পেনের ইকর ক্যাসিয়াসের কাছে আটকে যেতে হল তাঁকে, আটকে গেল হল্যান্ডের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নও। বায়ার্নে পরবর্তী কোচ ইয়াপ হেইঙ্কসও পাল্টালেন না রোবেনের ভূমিকা।
বায়ার্নে ফরাসি সতীর্থ ফ্রাঙ্ক রিবেরির সঙ্গে দুরন্ত জুটি বাঁধলেন রবেন। একই সঙ্গে দু-প্রান্তে দুই স্পেশালাইজড ইনভার্টেড উইঙ্গার। বাঁ-প্রান্তে ডান পায়ের রিবেরি আর ডান দিকে বাঁ পায়ের রবেন। ইনভার্টেড উইঙ্গারদের জুটি হিসেবে বিশ্বফুটবলের ইতিহাসে সাফল্যের বিচারে এই জুটির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হয়তো আর কোনও জুটি টিঁকবে না। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়-সহ বুন্দেনলিগাকে ‘বায়ার্ন লিগা’য় পরিণত করে ফেলার পেছনে সিংহভাগ কৃতিত্ব এই খেলোয়াড়েরা দাবি করতেই পারেন।
অসংখ্য গোল করলেন এবং করালেনও এই দুজন। রবেনের প্রচন্ড গতিতে ড্রিবল করতে করতে ভেতরে কাট করে ঢুকে বাঁ পায়ে কখনও দুরন্ত গতির শট নেওয়া কিংবা কখনও বাঁক খাইয়ে দুরূহ কোণ দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দেওয়া – এসবের সামনে গোলকিপারেরা আশঙ্কিত থাকতেন সবসময়েই।
আধুনিক সিস্টেম নির্ভর প্রেসিং ফুটবলে আরও একটা জিনিস অপরিহার্য। সেও ওই মাল্টিফাংশনিলিটির অঙ্গ হিসেবে। ফরোয়ার্ডদের ট্র্যাক ব্যাক করা। বিশেষ করে উইং ব্যাক আক্রমণে উঠে গিয়ে বল হারিয়ে ফেললে প্রতিপক্ষের জন্য যে ফাঁকা জমি তৈরি হয় সেই শূন্যতাকে ভরাট করা, রক্ষণভাগে নেমে গিয়ে বল পুনর্দখল করা এসব কাজেও এই উইঙ্গারদের ভূমিকা অপরিসীম।
বলা বাহুল্য, রোবেনের মত এই ক্ষমতাও সমসাময়িক উইঙ্গারদের মধ্যে কমই ছিল। বায়ার্নে ফিলিপ লাম কিংবা কিমিখকে এই বিষয়ে দারুণ সাহায্য করতেন রবেন। একই সঙ্গে শৈল্পিক ড্রিবলিং, গতি, শক্তি-স্ট্যামিনা ও বুদ্ধিদীপ্ত ফুটবলের মেলবন্ধন রোবেনের খেলাতে পাওয়া যেত।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো থেকে লিওনেল মেসি, ডি মারিয়া থেকে এডেন অ্যাজার অনেকেই জীবনের কখনও কখনও খানিকটা ইনভার্টেড উইঙ্গারের ভূমিকায় খেলেছেন। এঁদের আগেও বেশ কিছু খেলোয়াড় কিছু সময় জুড়ে এই ধরনের পজিশনে খেলেছেন। কিন্তু বর্তমানের স্পেশালাইজড রোল হিসেবে যে ‘ইনভার্টেড উইঙ্গার’ ভূমিকাটিকে আমরা চিনি তাকে কোনও খেলোয়াড় যদি সারা বিশ্বের কাছে মডেল হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়ে থাকেন তিনি এক এবং একমাত্র আরিয়েন রোবেন।
আধুনিক ফুটবলের শ্রেষ্ঠ ইনভার্টেড উইঙ্গার আরিয়েন রবেন!