পরপর তিনটি বৈশ্বিক শিরোপা হাতছাড়া করার মতো এক বিষাদগ্রস্থ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইলো নিউজিল্যান্ড। ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ, ২০২১ এ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ও এরপর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এই সবগুলো আসরের রানার্স আপ দলটির নাম নিউজিল্যান্ড। এমন দু:খ স্মৃতি নিশ্চয়ই তাড়িয়ে বেড়াবে নিউজিল্যান্ডের খেলোয়াড় থেকে শুরু করে দর্শক-সমর্থকদের। তবে এই স্মৃতি এটাও বোঝায় যে ক্রিকেটে নিউজিল্যান্ডের অবস্থান ঠিক কতটা শক্তপোক্ত।
ক্রিকেট ইতিহাসে যুক্ত হওয়ার পর থেকে প্রতিপক্ষের যথাযথ সমীহটা পেয়ে এসেছে ব্ল্যাকক্যাপরা। পাওয়াটা বেশ স্বাভাবিক। ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটের সত্যিকারের ভদ্রলোক হিসেবেই শুধু যে সমীহটা পেয়ে থাকে নিউজিল্যান্ড তা কিন্তু নয়। ব্ল্যাকক্যাপস বোলাররা যেমন বিধ্বংসী ঠিক তেমনি ব্যাটাররা নান্দনিক। নান্দনিক সেই সকল ব্যাটারদের টেস্ট ক্রিকেটে করা গুরুত্বপূর্ণ কিছু শতক নিয়েই হবে আজকের আলোচনা।
- নাথান অ্যাস্টল (২০০২)
ইংল্যান্ডে এক শক্তিশালী বোলিং আক্রমণ প্রায় কোনঠাসা করে দিচ্ছিলো নিউজিল্যান্ডের ব্যাটারদের। সেই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে নাথান অ্যাস্টল প্রতি-আক্রমণের পথ বেছে নেন। সেই আক্রমণ চালিয়ে তিনি তুলে নেন দ্বিশতক।
মাত্র ১৬৮ বলে ২২২ রান করেছিলেন নাথান অ্যাস্টেল সেবার। এখন অবধি টেস্ট ইতিহাসের দ্রুততম দ্বিশতকের রেকর্ডের শীর্ষে রয়েছে সেই ইনিংস। যদিও সেই ম্যাচটি ৯৮ রানে হেরে গিয়েছিলো নিউজিল্যান্ড।
- ব্রেন্ডন ম্যাককালাম (২০১৪)
ভারতের বিপক্ষে ইনিংসের শুরুতেই তিন উইকেট নেই ব্ল্যাকক্যাপসদের। স্কোরবোর্ডে জমা পড়েছে কেবলমাত্র ৫২ রান। সেই পরিস্থিতিতে ব্যাট করতে এলেন ফর্মের তুঙ্গে থাকা ব্রেন্ডন ম্যাককালাম।
দলের বিপর্যয় শক্তহাতে সামাল দেন ম্যাককালাম। খেলেন ৫৫৯ বল। নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহ ছাড়িয়ে যায় তিনশ রানের কোটা। তাঁর সেই পাহাড়ের ন্যায় দৃঢ় ও লম্বা ইনিংসের বদৌলতে ৬৮০ রানে আট উইকেট হারিয়ে ইনিংস ঘোষণা করেছিলো নিউজিল্যান্ড।
- জেরেমি কোনি (১৯৮৫)
একটা সিরিজ জয়ে দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নিউজিল্যান্ড। কিন্তু হাতে খুব বেশি উইকেট নেই। দুই ম্যাচের সিরিজে ১-১ সমতা হওয়ার একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলো পাকিস্তান। এমন পরিস্থিতিতে শেষের দিকের ব্যাটারদের দিক নির্দেশনা দিয়ে বাইশ গজে টিকিয়ে রাখেন জেরেমি কোনি সেই সাথে বাঁচিয়ে রাখেন নিউজিল্যান্ডের সিরিজ জয়ের আশা।
অন্যদিকে দৃঢ়চিত্তে সামলে নেন পাকিস্তানের পেস আক্রমণকে। খেলেন ২৪৩ বল। ১১১ রানে অপরাজিত থেকে জয় নিয়েই মাঠ ছাড়েন জেরেমি কোনি। দুই উইকেটের জয় পেয়েছিলো সেদিন নিউজিল্যান্ড।
- ইয়ান স্মিথ (১৯৯০)
নয় নম্বরে ব্যাটিং করতে নেমে সেই ১৯৯০ সালে এক অনবদ্য রেকর্ড গড়েছিলেন ইয়ান স্মিথ। সেই পজিশনে ব্যাট করা ব্যাটারদের মধ্যে ইনিংসে সর্বোচ্চ রান করার রেকর্ডটা এখনও নিজের দখলে রেখেছেন ইয়ান স্মিথ।
১৩১ রানে সাত উইকেট পড়ে যায় নিউজিল্যান্ডের ভারতের বিপক্ষে। সেই পরিস্থিতিতে ব্যাট করতে নেমে রেকর্ডের ফুলঝুরি ফোটান ইয়ান স্মিথ। নবম ব্যাটার হিসেবে সর্বাধিক ১৭৩ রান করেন ১৩৬ বল থেকে। এছাড়াও নিউজিল্যান্ডের পক্ষে দুইটি রেকর্ড পার্টনারশীপের অংশ ছিলেন তিনি।
- মার্ক গ্রেটব্যাচ (১৯৮৯)
প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৭৬ রানের এক ইনিংস খেলেছিলেন মার্ক গ্রেটব্যাচ। আর দ্বিতীয় ইনিংসটা তো স্মরণীয় হয়ে থাকার মতো এক ইনিংস।
ফলোঅনে পড়ে দ্বিতীয় দফা ব্যাট করতে নামা নিউজিল্যান্ড যখন ছিলো ইনিংস ব্যবধানে হারার শঙ্কায় তখন ম্যাচের ফলাফল বদলের প্রচেষ্টা চালান গ্রেটব্যাচ। সফলতাও আসে। ম্যাচটি ড্র হয়। তবে সেদিন ৪৮৫ বল খেলে ১৪৬ রান করেছিলেন তিনি। যা কিনা অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সবচেয়ে মন্থর গতির এক শতক।
- কেন উইলিয়ামসন (২০১২)
ইনিংস ড্র করতে টিকে থাকা চাই ক্রিজে। কিন্তু সেটা বড্ড কঠিন এক কাজ। ডেল স্টেইন এবং মরনে মরকেলদের মতো আগ্রাসী বোলাররা সেই কাজটা আরো বেশি কষ্টসাধ্য করে তোলে। তবে তাঁদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে থেকে ২০১২ সালে
নিউজিল্যান্ডের পক্ষে ড্র নিশ্চিত করেছিলেন কেন উইলিয়ামসন। ৮৩ রান পাঁচ উইকেট পড়ে যায় ব্ল্যাকক্যাপসদের। সেই পরিস্থিতিতে ঠান্ডা মাথায় ব্যাট করে ২২৮টি বল খেলে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে ১০২ রান। ছিলেন নট আউট।
- স্টিফেন ফ্লেমিং (২০০৩)
অধিনায়ক হিসেবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া বলতে যা বোঝায় তা করে দেখিয়েছিলেন স্টিফেন ফ্লেমিং ২০০৩ সালে শ্রীলঙ্কার মাটিতে। লঙ্কান ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা দুই বোলার চামিন্দা ভাস ও মুত্তিয়া মুরালিধরনের বিপক্ষে ঠায় দাঁড়িয়ে ব্যাট করেছিলেন স্টিফেন ফ্লেমিং।
সেই টেস্টটা ছিলো তাঁর অধিনায়ক ক্যারিয়ারের পঞ্চাশতম ম্যাচ। সে ম্যাচে ২৭৪ রানে অপরাজিত থেকে সন্তোষজনক ফলাফল ড্র নিয়েই তবে ড্রেসিং রুমে ফিরেছিলেন তিনি।
- মার্টিন ক্রো (১৯৮৫)
মাত্র ২২ বছর বয়সে অভিজ্ঞ এক ব্যাটার বনে গিয়েছিলেন মার্টিন ক্রো। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভংয়ক পেসত্রয়ী ম্যালকম মার্শাল, মাইকেল হোল্ডিং ও জোয়েল গার্নারদের বিপক্ষে ১৯৮৫ সালে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ রেখেছিলেন মার্টিন ক্রো।
১৮৮ রানের এক দূর্দান্ত ইনিংস খেলেছিলেন ক্রো। তাঁর সেই ইনিংসের বদৌলতে নিউজিল্যান্ডের সংগ্রহ গিয়ে দাঁড়ায় ৪৪০ রানে। যা তাদেরকে ফলোঅন এড়াতে সহয়তা করেছিলো। ক্রো সেই ভংয়কর ত্রয়ীর বিপক্ষে ৪৪০টি বল টিকে ছিলেন বাইশ গজে।
- গ্লেন টার্নার (১৯৭৪)
সেই ১৯৭৪ সালে তৎকালীন সেরা বোলার ম্যাক্স ওয়াকারের বিরুদ্ধে ব্যাট করেও পর পর দুই ইনিংসে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ শতক তুলে নিয়েছিলেন গ্লেন টার্নার। দ্বিতীয় ইনিংসে ১১০ রানে ছিলেন অপরাজিত।
তাঁর সেই ইনিংস নিউজিল্যান্ডের ইতিহাস গড়া জয় অর্জনে সহয়তা করেছিলো। অস্ট্রলিয়ার বিপক্ষে নিজেদের প্রথম জয় তুলে নিয়েছিলো নিউজিল্যান্ড সেবার। এছাড়া প্রথম ব্ল্যাকক্যাপস ব্যাটার হিসেবে পরপর দুই ইনিংসে শতক হাঁকানোর রেকর্ডের মালিক বনে যান গ্লেন টার্নার।
- রস টেলর (২০১৫)
সম্প্রতি বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ দিয়ে নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারের ইতি টেনে নিয়েছেন রস টেলর। এই ব্যাটার নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। তবে ২০১৫ সালে তিনি নিজেই এক রেকর্ড গড়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২৯০ রানের এক অসাধারণ ইনিংস খেলেছিলেন রস টেলর। যা কিনা অজিদের মাটিতে করা সফরকারী কোন ব্যাটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ। রেকর্ড গড়া সেই ইনিংসের পরও সেদিন ম্যাচটি ড্র হয়েছিলো। তবে টেলরের সেই ইনিংস নিঃসন্দেহে নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা একটি ইনিংস হয়েই রইবে চিরকাল।