২০১৩ সাল! ক্রিকেটের ক্যালেন্ডারে ২০০০ সালের পর সবচেয়ে অভিশপ্ত বছর বোধহয় এটাই! সেবার আইপিএলে যে চাঞ্চল্যকর স্পটফিক্সিংয়ের ঘটনা ঘটেছে তার সন্দেহের তীর ছিল মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের দিকে। স্পটফিক্সিংয়ের অভিযোগ অকপটে স্বীকার করে নিয়েছিলেন ভারতীয় পেসার শান্তকুমার শ্রীশান্থ। ২০১৩ সালের ১৭ মে আদালতের জেরায় নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছিলেন এই ভারতীয় পেসার।
তিনি জানিয়েছিলেন, ‘জিজু জনার্ধন’ নামের এক বুকি তাঁকে এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। এর আগে অবশ্য পুলিশি জেরায় ভেঙে পড়েন আর এক অভিযুক্ত অঙ্কিত চৌহান। তিনিও তার স্বীকার করে নিয়েছিলেন নিজের অপরাধ! এই গোটা স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারির মাস্টার মাইন্ড ছিলেন ‘সুনীল রামচন্দানি’ ওরফে ‘সুনীল দুবাই’! নামটা মনে রাখবেন। জুয়াড়ি মহলে অবশ্য এই সুনীল ‘জুপিটার’ নামেই খ্যাত। ‘চন্দ্রেশ’ নামক আরেক জুয়াড়ি টেলিফোনে এই সুনীলকে জুপিটার নামেই সম্বোধন করেছে।
অন্যদিকে, সেবার জুয়াড়িরা টাকার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীশান্থ ও অন্য দুই অভিযুক্ত ক্রিকেটারকে মহিলা সঙ্গের যোগানও দিয়েছিল বলে গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল। আইপিএলের সেই স্পট ফিক্সিং বিতর্কে জড়িয়ে গিয়েছিল রাজস্থান রয়্যালসের সাবেক ক্রিকেটার অমিত সিংয়ের নামও। এই অমিত জুয়াড়িদের হয়ে খেলোয়াড়দের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তাই গ্রেফতার করা হয়েছিল অমিত সিংকেও।
জুয়াড়িদের সঙ্গে আটক ক্রিকেটারদের কথোপকথনের যে টেপ পুলিশের কাছে রয়েছে তার থেকে স্পষ্ট জুয়াড়িরা ওই তিনজনের নারী এসকর্ট সার্ভিসেরও ব্যবস্থা করেছিল! ‘মানান’ ও ‘চাঁদ’ নামক দুই জুয়াড়ি অন্ততপক্ষে তিনবার শ্রীশান্থ ও অজিত চান্ডালিয়ার জন্য নারী সঙ্গের ব্যবস্থা করেছিল। মুম্বাইয়ের যে হোটেল থেকে শ্রীশান্থকে সেবার গ্রেফতার করা হয়েছিল সেখানে শ্রীশান্থের সঙ্গে একই কামরায় তখন এক নারীও ছিলেন।
বিতর্কিত পেসার শ্রীশান্থ সহ রাজস্থান রয়্যালসের দুই বোলারেকে পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতি ওভারে রান দেওয়ার জন্য ৬০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দেওয়ার কথা বলেছিল জুয়াড়িরা। খেলোয়াড়দের ফোন ট্যাপ করে এই তথ্যই তখন দিল্লি পুলিশের হাতে এসেছিল। যে প্রক্রিয়া মেনে টাকা-নারীসঙ্গের লেনদেন চলেছে, তা ডি-কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী। কেননা এই সুনীল দুবাই দাউদ ইব্রাহিমের একান্ত ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে অনেক জায়গায়ই!
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ!’
একটি অপহরণের ঘটনার তদন্তের কিনারা করতে গিয়ে ফোনে আড়ি পাতা । আর তাতেই দিল্লি পুলিশের এক কর্মকর্তা পেয়ে গিয়েছিলেন তাঁর ফোনের লাইন। কেঁচো খুড়তে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল সাপ। বিস্মিত দিল্লি পুলিশ জানতে পারল, আড়ি পাতা ফোনের এক প্রান্তে এক ক্রিকেট জুয়াড়ি। অন্য প্রান্তে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রোনিয়ে। এটাই ছিল ২০০০ সালে ক্রোনিয়ের গড়াপেটা কেলেঙ্কারি ধরার নেপথ্যের চাঞ্চল্যকর কাহিনি।
পূর্ব দিল্লির এক কাপড়ের ব্যবসায়ী থেকে ক্রিকেট জুয়াড়ি হিসেবে সারা বিশ্বে জাল বিছিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। সেই জুয়াড়ির নাম সঞ্জীব চাওলা। এবারো নামটা মনে রাখবেন! সঞ্জীব ছিলেন লন্ডন প্রবাসী ভারতীয় বংশোদ্ভূত ক্রিকেট জুয়াড়ি। ভারতে তার সহযোগী বাজিকর ছিলেন রাজেশ কালরা। দুজনে মিলে ক্রোনিয়ে ও প্রোটিয়া দলের কিছু ক্রিকেটারকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে ফিক্সিংয়ের পথে টেনে আনেন।
এর কিছু দিন পরই ফেঁসে যান তখনকার ভারতীয় ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন। তাকে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগে আজীবন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই)। একই কারণে অজয় জাদেজা, মনোজ প্রভাকর, নয়ন মোঙ্গিয়াসহ আরও কয়েকজন ভারতীয় ক্রিকেটারের ওপর শাস্তি নেমে আসে। আজহারউদ্দিনসহ এসব তারকাকে বেটিং জগতের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনে নাটের গুরু ছিলেন ‘মুকেশ গুপ্ত’ নামে এক জুয়াড়ি।
হ্যান্সি ক্রনিয়েকে আবার বেটিং জগতে প্রবেশ করিয়েছিলেন মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, সেই মুকেশ গুপ্তর মাধ্যমেই! ক্রনিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘১৯৯৬ সালে ভারতের বিপক্ষে কানপুর টেস্টের তৃতীয় দিন শেষে আমি আজহারের ফোন পাই। তিনি আমাকে সন্ধ্যায় রুমে ডাকেন। সেখানে তিনি আমাকে মুকেশ গুপ্ত নামক এক জুয়াড়ির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর আমাকে একা রেখে আজহার চলে যান।’
দক্ষিণ দিল্লির বাসিন্দা মুকেশ জুয়াড়ি মহলে ‘জন’ বা ‘এমকে’ নামেও পরিচিত। পারিবারিকভাবে স্বর্ণালঙ্কারের ব্যবসা ছিল তার। তবে ক্রিকেট জুয়া মারফত বিপুল অর্থসম্পত্তির মালিক হন তিনি।
এপ্রিল, ২০১১! ক্রিকেট জুয়ার সঙ্গে জড়িয়ে দুই জনের আত্মহত্যার খবর চাউর হয় গণমাধ্যমে। একজন ২৫ বছর বয়সী আশীষ কান্টালিয়া ও অপরজন ২৯ বছরের ক্রিকেটার বিজয় কুমার। উদয়পুরের ঘণ্টাঘরে নিজের বাড়িতে তার ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায়। যাওয়ার আগে একটা সুইসাইড নোট লিখে গিয়েছিলেন। সেখানে জানিয়েছিলেন, এক বাজিকরের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা ধার নিয়েছিলেন। ধার শোধ করতে পারছিলেন না, প্রাণনাশের হুমকিও পাচ্ছিলেন। আর সেসব সহ্য করতে না পেরেই মৃত্যুকে বরণ করে নেন তিনি। তখন পুলিশ মারফত উঠে আসে সেই বাজিকরের নাম, এই বাজিকর ছিলেন দীপক আগারওয়াল! এবারেও নামটা মনে রাখবেন।
- আশরাফুল কাণ্ড
তাঁকে বলা হয় বাংলাদেশের প্রথম সুপারস্টার! দুঃখের কথা, বাংলাদেশের প্রথম ‘স্বীকৃত’ ফিক্সারও তিনি! ২০০৪ সালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে নিজেদের শততম ওয়ানডেতে বাংলাদেশ হারিয়েছিল ভারতকে। পুরো দেশকে উৎসবে মাতিয়ে তোলা ওই দিনটিতেই আশরাফুলের গায়ে লাগে কলঙ্কের প্রথম ছিটা। ‘স্পট ফিক্সার’ হিসেবে আশরাফুলের অভিষেক যে এই ম্যাচেই। ম্যাচের আগের দিন টিম হোটেলেই জাভেদ নামে ভারতীয় এক বাজিকরের সঙ্গে আশরাফুলের যোগাযোগ হয়। সেখানেই জানানো হয় করণীয়, প্রথম ১৫ ওভারে কমপক্ষে ৬০ রান করতে হবে। সেটি বাংলাদেশ করেও ফেলে, যাতে এক চার ও দুই ছয়ে আশরাফুলের ৪১ বলে ২৮ রানের বড় ভূমিকা ছিল। এ জন্য আশরাফুল পান সাড়ে চার লাখ টাকা।
আশরাফুলের ফিক্সিং প্রসঙ্গ আসে এর পাঁচ বছর পর। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকে ফেরার পর আশরাফুলের পরিচয় হয় সুনীল ভাটিয়া নামের এক ভারতীয় বাজিকরের সঙ্গে! ‘সুনীল ভাটিয়া’ নামটি কি পাঠকের পরিচিত লাগছে? ২০১৩ তে শ্রীশান্ত-কাণ্ডে ভারতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এই সুনীল। সুনীলের চাওয়া ছিল ‘খুব সামান্য’। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ভারতের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে লাঞ্চের পর নির্দিষ্ট তিন ওভারে ছয় রান করতে হবে। সেটি প্রথম ইনিংসে না দ্বিতীয় ইনিংসে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে দুই ইনিংসেই লাঞ্চের আগে আউট হয়ে যাওয়ায় আশরাফুল ‘কাজ’টা যে করতে সক্ষম হননি এটা অনুমেয়!
বিশ্বের সব ক্রিকেট ম্যাচই স্ক্রিপটেড! বছরের শুরুতে ইংল্যান্ড থেকে দিল্লি পুলিশ তাকে ভারতে ফেরানোর পরে এমন বিস্ফোরক দাবি করেছেন জুয়াড়ি সঞ্জীব চাওলা। পাঠকের নিশ্চই সঞ্জীব চাওলার কথা মনে আছে। এই সঞ্জীব চাওলা যিনি কিনা যুক্ত ছিলেন হ্যান্সি ক্রনিয়ের ফিক্সিং কাণ্ডে! সঞ্জীব দিল্লি পুলিশের কাছে দাবি করেন, ‘ক্রিকেট অনেকটা সিনেমার মতো। দর্শক যা দেখছে পুরোটাই কোনও পরিচালক সেটা পরিচালনা করেছে। সিনেমায় যেমন পরিচালকই সব, এখানেও মাঠের বাইরে অদৃশ্য পরিচালকই ম্যাচ নিয়ন্ত্রণ করে। ফিক্সিং ছাড়া পৃথিবীতে কোনও ক্রিকেট ম্যাচ হয় না। যেহেতু ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সঙ্গে মাফিয়ারা সরাসরি জড়িত থাকে তাই ক্রিকেটারদের প্রাণসংশয়েরও আশঙ্কা থাকে।’
এমন কথা শোনার পর খেলাটার উপরে সাধারণ মানুষের যে নিবেদন, বিশ্বাস তা হয়তো এক নিমিষেই ভেঙে যাবে!
- সাকিব ও দীপক আগারওয়াল
২৯ অক্টোবর, ২০১৯! বাংলার আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা, কালো মেঘে ছেয়ে গেছে বাংলার আকাশ! বাংলার আকাশের ধ্রুবতারার পতন ঘটেছে এদিন! দীপক আগারওয়াল নামক এক জুয়াড়ির কাছ থেকে ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলেন বাংলার নবাব সাকিব আল হাসান। এ কথা সত্য, সাকিব আল হাসান ফিক্সিং করেছেন পাওয়া যায় নি এমন কোনো তথ্য! কিন্তু তাকে যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে এটা তিনি আকসুকে না জানানোয় পেয়েছেন এক বছরের নিষেধাজ্ঞা! পাঠক নিশ্চয়ই এই দীপক আগারওয়ালকে চিনতে পেরেছেন। বছরের শুরুতে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছেন দীপক আগারওয়াল, সেটা সাকিবঘটিত কোনো ঘটনায় নয়, টি-টেন লিগে দুর্নীতির অভিযোগে। জুয়াড়ি মহলে ডেভিড নামে পরিচিত এই জুয়ারিকে নিষিদ্ধ করতে কেন এত দেরি? যখন তার পরিচয় সবার জানা আগে থেকেই! প্রশ্ন তো রয়েই যায়।
ক্রিকেট জুয়ায় প্রত্যক্ষ যোগসাজস থাকলেও কেন জুয়াড়িরা বারবার পেয়ে যান ক্ষমা? কেন জুয়াড়িদের শাস্তি দেয়া সম্ভব হয় না? ফিক্সিংয়ের যে পরিনীতি কতটা ভয়াবহ? ফিক্সিংয়ের কারনে নিষিদ্ধ হয়ে ফিরে আসা কি এতই সহজ? সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো এবার।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ম্যাচ ফিক্সিং বা ম্যাচ ফিক্সিং নামক বিষাক্ত সাপের ছোবল এসেছে বহুবার, বারবার। স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনা আছে ২৩ টি। এর মধ্যে অখ্যাত খেলোয়াড় যেমন আছেন তেমনি আছেন নামি-দামি তারকা ক্রিকেটাররাও। তবে সবাই যে ফিক্সিং করতে গিয়েই নিষিদ্ধ হয়েছেন এমন নয়। ম্যাচে প্রভাব ফেলতে পারে- এমন কিছুর সঙ্গে জড়িয়েই সবচেয়ে বেশি ক্রিকেটার নিষিদ্ধ হয়েছেন। ক্রিকেটারদের ম্যাচ পাতানোর প্রশ্ন আসলে যে কারো মনেই প্রথম ভেসে আসে পাকিস্তানের নাম। ইতিহাসেও এর ব্যতিক্রম নেই! ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ফিক্সিংয়ের জন্য নিষিদ্ধ হন পাকিস্তানের সেলিম মালিক, আর স্পট ফিক্সিংয়ের জন্য নিষিদ্ধের তালিকায় সর্বশেষ সংস্করণ সেই পাকিস্তানেরই উমর আকমল!
ক্রিকেটকে সবাই ভদ্রলোকের খেলা বলেই জানে। তবে খেলাটির বানিজ্যিকীকরণের প্রভাব পড়েছে খেলোয়াড়দের মনোজগতেও। ‘অর্থই সকল অনর্থের মূল’, প্রবাদটি জানি আমরা সবাই! অনেক কিছুর মতো প্রবাদটি একেবারে সত্যি হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্রিকেটেও। টাকার পেছনে ছুটতে থাকা বেশ কিছু ক্রিকেটার নীতি বিসর্জন দিয়ে জড়িয়ে পড়েছেন ম্যাচ গড়াপেটার মতো ঘটনায়। টাকার বিনিময়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ম্যাচ হেরেছেন অথবা নিজেদের দলের পরিকল্পনা ফাঁস করে দিয়েছেন বুকিদের কাছে। এমন কিছু ঘটনা নিয়ে আলোকপাত করা যাক।
- দ্য হ্যান্সি গেট
এই শতকের ঠিক শুরুতে ফিক্সিংয়ের ঘটনায় প্রায় টালমাটাল হয়ে পড়ে ক্রিকেট দুনিয়া। ক্রিকেটের ইতিহাসের জঘন্যতম ম্যাচ ফিক্সিংয়ের এই ঘটনাকে বলা হয় ‘দ্য হ্যান্সি গেট’। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার একাধিক খেলোয়াড় জড়িয়ে পড়েন এই কেলেঙ্কারিতে। ২০০০ সালে ভারতের বিপক্ষে ২-০ তে সিরিজ জেতে দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই সিরিজেই দিল্লি পুলিশ ক্রনিয়ের ফোন-কলে আড়ি পাতে। পুলিশ অভিযোগ আনে, ম্যাচের আগে সন্দেহজনক কাউকে ম্যাচ-সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক। তবে ক্রনিয়ে তা অস্বীকার করেন। আবার, কয়েক দিন পর ক্রনিয়ে নিজেই বিষয়টি স্বীকার করে নেন।
সেই সফরের দ্বিতীয় টেস্টের আগে ক্যালিস, ক্লুজনার আর বাউচারকে টাকার বিনিময়ে ম্যাচ ছেড়ে দিতে বলেছিলেন ক্রনিয়ে। হ্যান্সি গেট কেলেঙ্কারিতে ক্রনিয়ে ছাড়াও ভারতের সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, অজয় জাদেজা, অজয় শর্মা, মনোজ প্রভাকর এবং দক্ষিণ আফ্রিকার হার্শেল গিবস, নিকি বোয়ে এবং হেনরি উইলিয়ামসের নামও উঠে আসে। এই ঘটনায় ক্রিকেট থেকে আজীবন নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় ক্রনিয়ে, আজহারউদ্দীন, মনোজ প্রভাকরদের। হার্শেল গিবস ও হেনরি উইলিয়ামসকে ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়।
- শেন ওয়ার্ন-মার্ক ওয়াহ-সেলিম মালিক
১৯৯৪ সালে সিঙ্গার কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টাকার বিনিময়ে দল এবং পিচ সংক্রান্ত তথ্য পাচার করেন এই দুই অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার। ১৯৯৮ সালে এই ঘটনা প্রকাশ পেলে তোলপাড় হয়ে যায় ক্রিকেট বিশ্ব। ওয়ার্ন ও মার্ক ওয়াহ অভিযোগ করেন, পাকিস্তানি ক্রিকেটার সেলিম মালিক তাদের বাজে খেলার প্রস্তাব দেয়। এজন্য প্রায় দুই লাখ ডলারও পান তারা।
তবে এই ঘটনায় তাদের নিষিদ্ধ করা হয়নি। ৮০০০ ডলার জরিমানা করা হয় যা তাদের ক্যারিয়ারে কালো দাগ হয়ে রয়েছে এখনো। তবে সেলিম মালিককে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়।
- ক্রিস কেয়ার্নস-লুই ভিনসেন্ট
ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী অলরাউন্ডার মনে করা হয় তাকে। ব্যাটিং, বোলিং সব দিক দিয়েই নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা ছিলেন ক্রিস কেয়ার্নস। কেয়ানর্সের বিপক্ষে অভিযোগটা আনেন সতীর্থ লুই ভিনসেন্ট।
২০০৮-এ ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে (আইসিএল) খারাপ পারফরম্যান্স করার জন্য কেয়ার্নস তাঁকে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়েছিলেন বলে জানান ভিনসেন্ট। ওই বছরই সাবেক আইপিএল চেয়ারম্যান লোলিত মোদী কেয়ার্নসের বিরুদ্ধে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ আনেন।
তারপর থেকেই ব কেয়ার্নস ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অন্যতম সেরা ‘নায়ক’ হয়ে ওঠেন। এই ঘটনায় কেয়ার্নসের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেন ব্র্যান্ডন ম্যাককালাম ও আন্দ্রে অ্যাডামস। তারপরে ২০১৪ সালে বিপিএল ও কাউন্টিতে ফিক্সিংয়ের অভিযোগে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ হন লুই ভিনসেন্ট।
- শতাব্দী কাঁপানো স্পট ফিক্সিং
২০১০ সালে ম্যাচ পাতানোর আরেক অভিনব পদ্ধতি দেখান সাবেক পাকিস্তান অধিনায়ক সালমান বাট এবং দুই পেসার মোহাম্মদ আমির ও মোহাম্মদ আসিফ।
৫ আগস্ট ২০১০। পাকিস্তানি জুয়াড়ি মাজেদ মাজহারের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে খোদ ক্রিকেটের মক্কা খ্যাত লর্ডসে ম্যাচ গড়াপেটা করেন সালমান বাট, মোহাম্মদ আমির ও মোহাম্মদ আসিফ। এই তিনজনকে ফিক্সিংয়ের বিষয়টি বুঝিয়ে দেন মাজিদ।
তিনটি ‘নো’ বলের জন্যে ১ লাখ ৪০ হাজার পাউন্ড নিয়েছিলেন বাট-আমির-আসিফ। এই ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া সালমান বাট দশ বছর, আসিফ সাত বছর ও আমির পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন।
মোহাম্মদ আমিরকে তৎকালীন সময়ে তুলনা করা হতো গ্রেট ওয়াসিম আকরামের সঙ্গে! মাত্র ১৯ বছর বয়সে ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ২০১৬ এশিয়া কাপে ফিরেই বোলিং কারিশমা দেখান মোহাম্মদ আমির।
- আইপিএল কেলেঙ্কারি
আইপিএলের ষষ্ঠ আসরে ভারতীয় দলের সাবেক পেসার শ্রীশান্ত স্পট ফিক্সিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত হন। সে আসরে পুনে ওয়ারিয়র্সের বিপক্ষে পেসার শ্রীশান্ত, কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে বোলার চান্ডিলা আর স্পিনার চাভান মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের বিপক্ষে ম্যাচ গড়াপেটা করেছেন বলে অভিযোগ আনে আইপিএল কতৃপক্ষ ও পুলিশ।
এক ওভারে ১৪ বা তার বেশি রান দেয়ার জন্য শ্রীশান্ত পান ৪০ লাখ রুপি, চান্ডিলা ও চাভান পান ২০ লাখ রুপি! ৫ মে, পুনে-রাজস্থান ম্যাচে চান্ডিলা তার নিজের দ্বিতীয় ওভারে দেন ১৪ রান। দ্বিতীয় ঘটনা ৯ মে, রাজস্থান-পাঞ্জাব ম্যাচে। সেই ম্যাচে শ্রীশান্ত তার দ্বিতীয় ওভারে দেন ১৩ রান। দোষ পুরোপুরি স্বীকার করে নেয়ায় নিষিদ্ধ হন সকলেই।
বলা হয়ে থাকে, ক্রিকেটের শত্রু ফিক্সিং। ফিক্সিংয়ের ইতিহাসও যে একেবারেই নতুন, তা কিন্তু নয়। যুগ যুগ ধরে ক্রিকেটে গড়ে উঠেছে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সাম্রাজ্য। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে আগে দোষীদের শাস্তি দেওয়া কঠিন ছিল। কিন্তু এখন তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে সহজেই ধরা পড়ছেন ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত ক্রিকেটাররা। অর্থের প্রলোভনে পরে এই ঘৃণিত কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন তারা। বারে বারে নিষিদ্ধ হচ্ছেন ক্রিকেটাররা, ক্ষণে ক্ষণে পাচ্ছেন শাস্তি। অর্থের প্রলোভনে পরে খুইয়েছেন নিজের ক্যারিয়ার, এমন উদাহরণ আছে ভুড়িভুঁড়ি! চাইলেই যে আবার নিজের পুরোনো রাজ্যে রাজা হয়ে বসবাস করা সম্ভব নয় তা হয়তো কেউ ফিক্সিংয়ের আগে ভাবেননিও। এখন পর্যন্ত প্রায় ২৩জন ক্রিকেটার নিষিদ্ধ হলেও, পরবর্তীতে ক্রিকেটে ফিরতে পেরেছেন মাত্র তিনজন!
২০০০ সালের সেই বিখ্যাত ‘দ্য হ্যান্সি গেট’ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে আজীবনের জন্য ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হন হ্যান্সি ক্রনিয়ে, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন ও মনোজ প্রভাকর। হার্সেল গিবস হেনরি উইলিয়ামস ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা ভোগ করলেও পরবর্তীতে ক্রিকেটে ফিরতে পারেন শুধুই হার্শেল গিবস।
- স্যামুফেলস পর্ব
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটার মারলন স্যামুয়েলস দলের গোপন তথ্য জুয়াড়িদের কাছে পাচার করার জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। ২০০৭ সালে নাগপুরে অনুষ্ঠিত ভারত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার প্রথম ওয়ানডেতে ভারতীয় পুলিশ স্যামুয়েলসকে নিজ দলের তথ্য লেনদেনের কারণে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পুলিশ দাবি করে, এক জুয়াড়ির সঙ্গে তিনি টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছিলেন যা গোপনে ধারণ করা হয়। এর ফলে তাকে দুই বছরের জন্য ক্রিকেট জীবন থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আবারও ক্রিকেটে ফিরে দুইবার টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে।
প্রযুক্তির এই উৎকর্ষের যুগে কিছু দুঃসাহসিক সাংবাদিকের কল্যানে ফাঁস হয়েছে ফিক্সারদের পর্দা, উন্মোচন হয়েছে সত্যের। তবুও বারবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় ক্রিকেটারদের প্রভাবিত করা সেইসব জুয়াড়িরা! দিল্লী-মুম্বাই-লন্ডন-দুবাইয়ের ভারতীয় জুয়াড়ি কিংবা, ভারতীয় বংশোদ্ভূত জুয়াড়িরাই মূলত নিয়ন্ত্রণ করছে ফিক্সিংয়ের রাজ্য। আর এই ফিক্সারদের মাথার উপর বটবৃক্ষ হয়ে থাকেন মাফিয়ারা, আদতে দাউদ ইব্রাহিম আর তার ডি-কোম্পানি! হ্যান্সি গেট কেলেঙ্কারির মাস্টার মাইন্ড সঞ্জীব চাওলা দিল্লি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যে বোমা ফাঁটালেন, তাতেই স্পষ্ট চাইলেই ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না ডি-কোম্পানির জুয়াড়িদের! দিল্লী পুলিশের কাছে নিজের বক্তব্যে সঞ্জীব শেষটায় জুড়েছেন, ‘ক্রিকেট বেটিংয়ের সঙ্গে সিন্ডিকেট বা মাফিয়ারা যুক্ত, তারা প্রচণ্ড বিপজ্জনক। তাই এর চেয়ে বেশি কথা বলা যাবে না। এতে প্রাণ সংশয় থেকে যাবে।’
তাহলেই বুঝুন, একজন মাফিয়া এজেন্ট একেবারে কম শক্তিশালী নয়, সেই যখন ভয় পায় তাহলে সাধারণ ক্রিকেটাররা ভয় কেন পাবেন না?
কাতারভিত্তিক জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল আল-জাজিরার স্টিং অপারেশনে ধরা পড়ে অনিল মুনাওয়ারের নাম। তার থেকে পাওয়া যায় ফিক্সিংয়ের চাঞ্চল্যকর সকল তথ্য। অনিলের পর্দা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর, অনিলের দেখা পায় নি আর কেউই। না আইসিসি, না কোনো গোয়েন্দা সংস্থা। তাহলেই বুঝুন ডি-কোম্পানি কতটা ক্ষমতাবান। সেই প্রতিবেদনে অনিলের একটা বক্তব্য লক্ষ্য করা হয়, ‘ইফ ইউ হ্যাভ মানি, ইউ উইল ডু এনিথিং!’
টাকাই তাহলে সর্বেসর্বা, সকল নাটের গুরু! আর একবার যিনি ডি কোম্পানির থেকে ফিক্সিংয়ের জন্য টাকা নিয়েছেন, তার আর কোনো ফেরার রাস্তা নেই, হয় ব্ল্যাকমেইলিং নাহলে প্রাণনাশের হুমকি! এজন্যেই বোধহয় ধরা পড়লেও কখনো ফিক্সারদের নাম প্রকাশ করে না ক্রিকেটাররা। এর ফলে বারবার লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায় জুয়াড়িরা, ফলে হয়তো কখনোই নির্মূল করা সম্ভব হবে না ফিক্সিংয়ের গাছ-গাছড়া!
ফিক্সিং নির্মূল করতে হলে, উপড়ে ফেলতে হবে ফিক্সিংয়ের শেকড়, ধ্বংস করতে হবে ডি-কোম্পানি! যা আদতে অসম্ভব! প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করা কিংবা নিজ স্বার্থ হাসিলে দাউদ ইব্রাহিমের জুড়ি মেলা ভার! ক্রিকেটাররা আইসিসির কাছে দায়বদ্ধ, কিন্ত জুয়াড়িরা দায়বদ্ধ নয়! তাই চাইলেও জুয়াড়িদের শাস্তি দিতে পারে না আইসিসি ওরফে আকসু। তারা সর্বোচ্চ সত্য উন্মোচন এবং তথ্য প্রকাশ করতে পারে কিন্তু শাস্তির এখতিয়ার শুধুমাত্র আছে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর! আর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কিভাবে ম্যানেজ করে ডি-কোম্পানি তাদের ফিক্সিংয়ের ঘুড়ি উড়ায় তা বোঝা যায় অনিল মনোয়ারের একটা কথাতেই, ‘ইফ ইউ হ্যাভ মানি, ইউ উইল ডু এনিথিং!’