ব্রাজিলের রণকৌশল ডিকোডেড

ব্রাজিল-সার্বিয়া ম্যাচ নিয়ে কিছু বলার আগে প্রথমেই কিছু কথা বলে নেওয়া ভাল। পাঁড় ব্রাজিল সাপোর্টার হিসেবে বেজায় খুশি আসলে। তার অনেক কারণের মধ্যে একটা, এই ব্রাজিলটা বহুবছর পরে একটা বিশ্বকাপ খেলতে এসেছে সবচেয়ে স্ট্রংগেস্ট টিম হিসেবে। স্কোয়াডটাকে তিতে গড়তে শুরু করেছিলেন ২০১৭ থেকে।

২০১৬ কোপাতে হারার পর থেকেই যা রিবিল্ড শুরু। পাওলিনহা, ফেলিপে, দান্তে – কে না খেলেনি! ছোট-বড়-মাঝারি, সব ধরণের প্লেয়ার নিয়ে টানা এক্সপেরিমেন্টেশনের পর কাতারে এসেছে এই স্কোয়াডটা। যেখানে ফিলিপ কুটিনহো নেই, রবার্তো ফিরমিনো নেই, গ্যাব্রিয়েল বারবোসা নেই। টুর্নামেন্ট, ফ্রেন্ডলি – কিছুতে বাদ ছিল না এক্সপেরিমেন্টেশনে। একটা সেট আপ ধীরে ধীরে গড়ে লাস্ট চার-পাঁচ বছর ধরে তবে আজ এই জায়গায়। আর শুরুতেই ডমিনেট করে জয়। কেন? খেলায় তাকানো যাক।

আগেই বলেছি স্কোয়াড ডেপথ মারাত্মক ভাল। বিশেষত অ্যাটাক। যদি তাকাই অ্যাটাকে দিকে তাহলে দেখতে পাব, এই টিমের আক্ষরিক অর্থে নাম্বার নাইন গ্যাব্রিয়েল জেসুস। ম্যান সিটিতে ডানদিকে সরে খেলা জেসুস অ্যাটাক বিল্ডাপে মেনলি হেল্প করতো, ট্র্যাঙ্গেল প্লে হোক কি হোল্ডিং, রাইট মিড আর ব্যাকের সাথে ত্রিভুজ তৈরী করে স্পেস ক্রিয়েশন – সবই করত সিটিতে। কিন্তু আর্তেতা আর্সেনালে ওকে নিয়ে আসার পর জায়গা দিল প্রপার নাম্বার নাইন হিসেবে আর তখনই নিজের সহজাত খেলা খেলতে শুরু করল জেসুস।

কিন্তু তিতের টিমে নাম্বার নাইন টটেনহ্যামের রিচার্লিসন। এবং যে ফর্মে নেই। এভার্টনে থাকাকালীন এক সিজনে ১০ গোল। তাহলে রিচা কেন? কারণ জেসুস শুধুই স্ট্রাইকার নয়। জেসুস পিভটে প্লে খেলে, দুটো সেন্টার ব্যাককে চাপে রাখে এবং নিচে নেমে খেলা তৈরিতেও হেল্প করে। আর রিচা শুধুই গোলটা চেনে। প্লাস, হেড ভাল, ভিশন ভাল, দু’পায়ে শট আছে। নেইমারের সঙ্গে বক্স প্লেতে ভয়ানক কার্যকরী। জিততে গেলে গোল দরকার আর সেটার জন্যই এই নয়া ব্রাজিলে রিচার্লিসন নাম্বার নাইন।

সার্বিয়া ৩-৫-১-১ তে নেমেছিল। ৩ ব্যাক সিস্টেমে দুটো সাইডব্যাক ম্ল্যানডেনোভিচ আর জিপকোভিচ ওভারল্যাপে উঠে বক্স মিডের সাথে এক-দুটো টাচে ওয়াল খেলে বহুবার বেরোতে চেষ্টা করেছিল। বাঁয়ের ওয়াইড মিড মিলিঙ্কোভিচ-স্যাভিচ আর ডানদিকে একটু ওপরে অ্যাজাক্সের ডুসান ট্যাডিচ। দুটো ওভারল্যাপিং উইংব্যাকের কারণে ড্রাজান স্টয়কোভিচ আর ব্লাহোভিচকে নামাননি। চার ব্যাকের মাঝের ওয়ালে একটা চোরা পাস দিলেই ইনফর্ম স্ট্রাইকার মিত্রোভিচ ছিলই।

কিন্তু, সে স্ট্র্যাটেজি ধোপে টেকেনি। অন দ্য বল ব্রাজিল তিন ব্যাক সিস্টেমে চলে আসছিল। বাঁয়ে আলেক সান্দ্রো লেফটব্যাক থেকে ফুলব্যাক হওয়ার ফলে ইনভার্টেড ফুলব্যাক হিসেবে ডানদিক থেকে মিডে জয়েন করছে দানিলো। ব্রাজিল-টিউনিশিয়া ম্যাচটা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে তিতে কোন ফর্মে চালাচ্ছেন টিমটাকে। প্লাস, নিচের গ্রাফে প্রথম হাফে নেইমারের পজিশন।

নাম্বার টেন থেকে নাম্বার এইট হয়ে দুটো ডিফেন্সিভ মিডের সামনে দেখে বল হোল্ড করে আপফ্রন্টে পাস জোগানো যার কম্মো। আর এইসঙ্গে অপোনেন্টের দুটো ম্যানকে টেনে নিচে নামানো যাতে বাঁদিকে ইনভার্টেড উইঙ্গার ভিনিসিয়াস অনেকটা স্পেস পান। ইনফ্যাক্ট, ম্যাচে সেটাই হল। খেয়াল করলে দেখা যাচ্ছে, নেইমার বেশিরভাগ সময় বল ধরছেন জোন ১০, ১১ নয় ১৩। ১৪তে উঠছে।

অর্থাৎ নেইয়ের অন দ্য বল পজিশনিংয়ের উপর নির্ভর করে ডিফেন্সিভ মিড পাকেতা উপরে উঠে আসছেন এবং একটু নিচে ব্লকার হিসেবে লুজ বল ধরার ক্ষেত্রে রয়ে যাচ্ছে কাসেমিরো। পাকেতার পাশে দানিলো এবং ওয়াইডে রাফিনহা। এই সময় সার্বিয়া হয়ে যাচ্ছে ৫-২-২-১ ফর্মে, যেখানে দুটো ইনভার্টেড উইঙ্গার কাট ইন করে ঢুকতে গেলেই বাঁধা পাচ্ছে এবং ডিফেন্সিভ লাইনের সাথে মাঝমাঠের দূরত্ব বেশি নেই বলে সেকেন্ড বলটা ধরতে ছুটে আসছে দুটো মিড। পাকেতা একবার সেখান থেকেও রাফিনহার সাথে একটা টাচে স্পেস বার করে দিল, আর রাফিনহা বল জমা করল কিপারের হাতে।

সার্বিয়া টিমটা ভালই স্ট্রং। অ্যাডভান্টেজ হল সবকটা প্লেয়ার লম্বা এবং হেডে পারদর্শী। যেটা দেখতে পাই সেকেন্ড হাফের একটা কর্নারে। কিন্তু শেষমেশ হার স্বীকার করতে হয় বৈচিত্র্যের কাছে। প্রথম গোলটার ক্ষেত্রেই ধরা যাক। পাকেতার কাছ থেকে নেইমার বলটা ধরার সময় সার্বিয়া ৪-২-৩-১। চার ব্যাকের দুটো ওয়াইডে ভিনি আর রাফিনহা, মাঝে রিচা। এই সময় নেইমার বলটা ধরেই রান লাগালো দুটো মিডের মাঝখান দিয়ে।

বল গেল ভিনির কাছে আর সেখানে জমা হল তিনটে ম্যান। এর ফলে গোলের কাছে খোলা জায়গায় ঢুকে পড়ল রাফিনহা আর রিচা। ভিনির শট প্রতিহত, সেকেন্ড বলে রিচার গোল। দ্বিতীয় গোলটা আউটস্ট্যান্ডিং, কিন্তু তার আগে যদি তাকাই তাহলে নজর পড়বে নেইয়ের পজিশনে। সেই আট নম্বর জায়গা থেকেই নেই বল ধরে ভিনির কাছে পাঠায়। সামনে দুটো ম্যান, রিচা একটা স্পেসে। ভিনি তিনটে ম্যানের মধ্য দিয়ে বল পাঠায়, আর তারপর তো।

তিতের এই অন দ্য বল তিন ব্যাকে চলে যাওয়ার সিস্টেমটা খুব কার্যকরী হয়ে উঠেছে। লাস্ট ইয়ার কোপাতেও তিতেবাবু এমনটা করেছিলেন ভেনেজুয়েলা ম্যাচে। আর হবে নাই বা কেন! এত এত অপশন নিয়ে তিতেবাবু এসছেন কাতার জয় করতে। ভিনি উঠে মার্টিনেলি নামল, রাফিনহা উঠে অ্যান্টনি। যে দুজনেই ড্রিবলে ওয়ান অন ওয়ান সিচুয়েশনে অসম্ভব ভাল।

কিন্তু, স্টার্ট করেনি কারণ ট্র্যাকব্যাকে সমান সাবলীল নয়। সেখানে ভিনি লাস্ট সিজনে ম্যাঞ্চেস্টার সিটির এগেন্সটে যে গোলটা করেছিল সেটা ওই ট্র্যাকব্যাকেরই ফসল। প্লাস, পাকেতা। লিঁও থেকে ওয়েস্ট হ্যামে এল এবছর। এত ভাল বক্স টু বক্স মিড, পজিশনিং সেন্সওয়ালা মিড ব্রাজিল অনেকদিন পর পেয়েছে। বদলি আছে ফ্রেড, যার ফর্ম খারাপ চললেও স্পেস ক্রিয়েট করার একটা চোরাগোপ্তা ব্যাপার আছে।

আগেই বলা আছে এই বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠ স্কোয়াড ব্রাজিলের। প্লাস, কাতারে ওয়েদার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। ইউরোপীয়ান টিমগুলোর পক্ষে তো বটেই, লাতিন আমেরিকান টিমগুলোর ক্ষেত্রেও পুরো ৯০ মিনিট টানা প্রেসিং সম্ভব হচ্ছে না। যেটা পুরোমাত্রায় দেখা গেল জাপান-জার্মানি ম্যাচে। আর তাই ৫ সাবস্টিটিউটশন খুব মারাত্মক একটা রোল প্লে করতে চলেছে নক আউট স্টেজ থেকে। যার স্কোয়াড ডেপথ যত ভাল, সে বাজি মারবে। এই কারণেই ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন এবারে এগিয়ে।

ব্রাজিলের সবে প্রথম ম্যাচ। সামনে সুইজারল্যান্ড, ক্যামেরুন। সুইজারল্যান্ড কিছুটা শক্ত গাঁট। প্লাস, নেই খেলছে না পরের দুটো ম্যাচ। বিকল্প হাতে আছে ঠিকই, কিন্তু নেইয়ের জোন ১০ পজিশনিংটাও গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে তিতেবাবু নতুন কি খেল দেখান, দেখা যাক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link