গতির সাথে আপোষহীন জীবন

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটি ম্যাচে বোলিংয়ের সময় হাতে ব্যাথা পান, এমন ব্যাথা যে ব্যাথায় অন্য খেলোয়াড় হলে সাথে সাথেই মাঠের বাইরে চলে যেতেন। কিন্তু তিনি যাননি, মনের জোরে বোলিংয়ে আসেন, আগের বলগুলো যেখানে ছিল ১৫০ এর উপরে সেখানে এরপরের বলের গতি শত চেষ্টায়ও ১৩০ এর উপরে নিতে পারেন নি৷ব্যাপারটি অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ’র নজরে আসলে জিজ্ঞেস করেন, ‘কোনো সমস্যা?’ নির্বিকার লি’র জবাব, ‘কিছু না! হাতটা হয়তো ভেঙেছে!’  বুঝুন অবস্থা!

গন্তব্যটা বেশ আগে থেকেই নির্ধারণ করে ফেলেছিলেন, বল ছুঁড়বেন সবচেয়ে গতিতে, আলো ছড়াবেন হলুদ জার্সির হয়ে। তখন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গতি তারকার নাম জেফরি থমসন। এই অজি পেসার ঘণ্টায় ১৬০ কিলো গতিতে বল করতেন।

দেশটির নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের ওলনগংয়ের একটি ছোট্ট ছেলে সেই থেকেই স্বপ্ন বুনতে থাকেন একদিন তিনিও বল ছুঁড়বেন, আদর্শ মানা জেফরি থম্পসনের চেয়েও বেশি গতিতে।

শৈশব থেকেই স্টাম্প উপরে ফেলার নেশায় মত্ত্ব থাকা ছেলেটির স্বপ্ন পূরন হয়েছিল, বাড়ির উঠোন থেকে বাইশ গজের পিচে ঝড় তুলে আদর্শ মানা জেফরি থম্পসনের চেয়েও দ্রুত গতিতে বল করলেন,শৈশবের স্বপ্ন তখন হাতের মুঠোয়, আর ঝড় তোলা বোলারের নাম ব্রেট লি।

১৯৭৮ সালের ৮ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের ওলনাগং এলাকায় জন্ম। কৈশোর পেরোনোর আগে থেকেই ক্রিকেট পাগল। কোনো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি নয় বছর বয়সেই জানতাম আমি কি হতে চাই জীবনে!  মা-বাবা আমাকে প্রশ্ন করলে আমি উত্তর দিতাম, আমি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলতে চাই আর ঘণ্টায় ১৬০ কিলো গতিতে বল করতে চাই।’

গতিতে বিধ্বস্ত করে স্টাম্প ভেঙে ফেলাটা নেশা ছিল। অনূর্ধ্ব- ১০ দলের হয়ে অভিষেক ম্যাচে দলের হয়ে প্রথম ওভার করতে আসেন। প্রথম ওভার শেষে স্কোর ছিল ১-১-০-৬!  হ্যাঁ, সত্যিই দেখছেন! শিশু ব্রেট লির প্রতিটি বল স্টাম্প ভেদ করেছিল, ওভারের প্রতিটি বলেই উইকেট নিয়েছিলেন। প্রতিপক্ষ দলের বাচ্চাদের তখন কান্না থামায় কে!

১৯৯৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভারতের বিপক্ষে মেলবার্নে স্বপ্নের ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ মাথায় পরেন। নিজের করা ওভারের চতুর্থ বলেই বোল্ড করেন সাদাগোপান রামেশকে। তারপর বাউন্স, সুইং এবং গতি দিয়ে একে একে উইকেট নিলেন পাঁচটি।

টেস্ট অভিষেকের এক বছর পর অভিষেক হয় ওয়ানডে ফরম্যাটে। তবে শুরুটা টেস্টের মত রাজসিক হয় নি, প্রথম তিন ম্যাচে কোনো উইকেটের দেখা পাননি ব্রেট লি। তবে বেশি সময়ও নেন নি!  নিজের সপ্তম ম্যাচেই ভারতের বিপক্ষে আদায় করে নেন পাঁচ উইকেট।

ব্রেট লির আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু ঠিক এভাবেই। অজিদের হয়ে নিয়মিত বল করতে থাকেন,ঝড় তুলতে থাকেন বাইশ গজের পিচে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাত্রাটা মোটেই মসৃন ছিল না। পেস বোলারদের নিয়মিত শত্রু ইনজুরি, সেই ইনজুরিতে ছিটকে গিয়েছিলেন বারবার, তবে ফিরে এসেছেন অতীতের চেয়ে আরও ভয়ংকর রুপে৷

সাধারণত পেসাররা চোট-ইনজুরি থেকে ফিরে আসলে গতি কমিয়ে নেন। সে জায়গায় লি ছিলেন বিপরীত অবস্থানে। অসংখ্যবার চোটে পরলেও গতির সাথে কখনোই আপোষ করেন নি। ইনজুরি পরেছেন, লম্বা সময় পর ফিরে এসেছেন কিন্তু গতি কমাননি।

পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই ভক্তরা একটা অদৃশ্য দ্বৈরথ দেখতে পেতেন ব্রেট লি এবং পাকিস্তানের শোয়েব আখতারের মাঝে। দুই গতি তারকার দ্বৈরথ!  দুজনেই ১৫০ এর উপরে গতিতে নিয়মিত বল করতেন।  ২০০৫ সালে ব্রেট লি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১০১.১ অর্থাৎ ১৬১.১ কিলো গতিতে বল করেন, যা এখনো ক্রিকেটের সবচেয়ে দ্রুত গতির বোলিংয়ের বেলায় দ্বিতীয়। প্রথমে অবস্থানে থাকা শোয়েব আখতারের করা ১৬১.৩ কিলো গতির বোলিং।

টি-টোয়েন্টির প্রথম বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন, যা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে প্রথম হ্যাটট্রিক। ব্রেট লি একমাত্র বোলার যিনি টি-টোয়েন্টি এবং ওয়ানডে বিশ্বকাপ –  দুই ইভেন্টেই হ্যাটট্রিকের স্বাদ নিয়েছেন।

উইকেট শিকারের মাঝে থেকে তিনি সর্বকালের সেরা দশের একজন। সব ফরম্যাট মিলিয়ে যার উইকেট সংখ্যা ৭১৮ টি। টেস্টে ৩১০ এবং ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার জার্সি পরে শিকার করেন ৩৮০ উইকেট। ইনজুরির থাবায় টেস্ট ক্যারিয়ারকে সময়ের আগেই বিদায় দিয়েছিলেন, নয়তো টেস্টের উইকেট সংখ্যা আরও চমকপ্রদ হওয়ারই কথা ছিল।

গোড়ালির চোটের কারণে ২০০৭ এর বিশ্বকাপ খেলতে পারেননি। ইনজুরির কারনে ক্যারিয়ারে শল্যবিদের ছুড়ির নিচে যেতে হয়েছে ছয় বার। প্রতিবারই ফিরে এসেছিলেন দুর্দান্ত রুপে, চিরচেনা ব্রেট লি হয়ে।

টেস্ট ওয়ানডে উভয় ফরম্যাটেই তিনশো এর উপরে উইকেট শিকার করেও লি’র সাদামাটা মন্তব্য, ‘আমি অজিদের হয়ে তিনশো উইকেট শিকার করব কখনোই ভাবিনি, আমি উচ্ছ্বসিত আমার ক্যারিয়ার নিয়ে,আমি সন্তুষ্ট। তবে হ্যাঁ, পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই আমার কাছে উইকেটের চেয়ে প্রাধ্যান্য পেয়েছে গতি।’

অজিদের হয়ে খেলার পাশাপাশি ব্রেট লি সব রকমের ফ্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে হট কেক ছিলেন। আইপিএল -বিগ ব্যাশেও গতি দিয়ে নাকানি চুবানি খাইয়েছেন প্রতিপক্ষকে।  গতিতে তিনি এতোই মোহক্রান্ত ছিলেন যে ফিল্ডিংয়ের সময় ব্যাটসম্যান রান না নিলেও লি বল ছুঁড়তেন সবচেয়ে গতিতে। আর ডেডিকেশন, এখানে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটি ম্যাচে বোলিংয়ের সময় হাতে ব্যাথা পান, এমন ব্যাথা যে ব্যাথায় অন্য খেলোয়াড় হলে সাথে সাথেই মাঠের বাইরে চলে যেতেন। কিন্তু তিনি যাননি, মনের জোরে বোলিংয়ে আসেন, আগের বলগুলো যেখানে ছিল ১৫০ এর উপরে সেখানে এরপরের বলের গতি শত চেষ্টায়ও ১৩০ এর উপরে নিতে পারেন নি৷

ব্যাপারটি অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ’র নজরে আসলে জিজ্ঞেস করেন, ‘কোনো সমস্যা?’ নির্বিকার লি’র জবাব, ‘কিছু না! হাতটা হয়তো ভেঙেছে!’  বুঝুন অবস্থা!

স্টিভ ওয়াহ তাঁর সম্পর্কে বলেন, ‘পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে ব্রেট লি তার শতভাগই দিয়ে গিয়েছে। নিজের শরীরের উপর কত ধকল সহ্য করতে হয়েছে তার। এত গুলো চোট সারিয়ে আবার ফিরে আসা সহজ কথা নয়!  আমি নিশ্চিত আমার ছেলের মতোই আরও অনেকেই ব্রেটকে আদর্শ মানে।’

স্বপ্নের পেছনে ছুটেছেন, বাড়ির উঠোন থেকে যে গল্পের শুরু সেই গল্পের শেষ একেছেন নামের পাশে কয়েকটি  অ্যাশেজ আর ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ জিতে।  নব্বইয়ের শেষ বেলায় ক্যারিয়ার শুরু করে ১৩ বছরের ক্রিকেট জীবনের ইতি টেনেছেন ২০১২ সালে। গতি দিয়ে মাতিয়ে রেখেছিলেন পুরো একটি প্রজন্ম। উইকেট পেয়ে হাঁটু ভেঙে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে শূন্যে ক্রমাগত ঘুষি ছোড়া – এমন উদযাপন লাইভ দেখতে পারারা সৌভাগ্যবান মানতে পারেন নিজেদের।

ব্রেট লি’র মাঠের বাইরের জীবনটাও বরাবরই বেশ বর্ণাঢ্য। গানবাজনার সাথে জড়িত ছিলেন, ধারাভাষ্য দিয়েছিলেন। অভিনয় করেছেন। যেন তেন অভিনয় নয়, রীতিমত ভারতীয় সিনেমাতে দেখা গিয়েছে বিঙ্গাকে!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...