১.
সময়টা ১৯৯৯, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম অস্ট্রেলিয়া সিরিজের তৃতীয় টেস্ট। সিরিজে ১-১ সমতা থাকায় দুই দলই মরিয়া এই টেস্ট জিতে সিরিজ জয়ের পথে এগিয়ে যেতে। ব্রিজটাউনে টস জিতে ব্যাটিং নিতে দ্বিধা করেননি অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ। নিজের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতেই যেন নেমেছিলেন তিনি, ১৯৯ রান করে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আউট হন আর অস্ট্রেলিয়া পায় ৪৯০ রানের বিশাল সংগ্রহ।
জবাবে শেরউইন ক্যাম্পবেলের সেঞ্চুরিতে প্রথম ইনিংসে ৩২৯ রান করতে পারে ক্যারিবিয়ানরা। সময় গড়াতে গড়াতে বদলাতে থাকে উইকেটের চরিত্র। চতুর্থ দিনে গিয়ে তা যেন হয়ে ওঠে ব্যাটসম্যানদের জন্য মরণফাঁদ!
দ্বিতীয় ইনিংসে কোর্টনি ওয়ালশ, কার্টলি অ্যামব্রোস,প্রেড্রো কলিন্সরা ধসিয়ে দেন অজি লাইনআপকে। অজিদের মাত্র ১৪৬ রানেই গুটিয়ে দিতে নেতৃত্ব দেন মাত্র ৩৯ রানে ৫ উইকেট নেওয়া ওয়ালশ।
তবে প্রথম ইনিংসে পাওয়া ১৬১ রানের লিডের কারণে ক্যারিবিয়ানদের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ৩০৮। টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে তিনশর বেশি তাড়া করা এমনিতেই কঠিন তারউপর বিপক্ষ দলে যদি থাকে ম্যাকগ্রা, ওয়ার্ন, গিলেস্পিদের মতো বোলার,সেখানে ড্র করাও পাহাড়সম কঠিন। দিনের উইকেট বিচার করলে অনেক সময় তা অসম্ভবেরও কাছাকাছি। পাঁড় ক্যারিবিয়ান ভক্তও দুবার ভাববেন এই ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের উপর বাজি রাখতে। তার উপর যারা আবার তিন অঙ্কে পৌঁছনোর আগেই হারিয়ে বসে টপ অর্ডারের পাঁচ ব্যাটসম্যানকে, তাদের জন্য ম্যাচ জয় তো দূরে থাক সম্মানজনক হারও বহু দূরের পথ।
কিন্তু একজন ভেবে রেখেছিলেন অন্য কিছু! একে তো তিনশ’র উপর রান তাড়া করে জেতার মানসিক চাপ। তার উপর মরার উপরে খারার ঘা হিসেবে ১০৫ রানেই অর্ধেক ব্যাটসম্যান চলে গেছেন ড্রেসিংরুমে। আড়াইশ ছোঁয়ার আগে নেই ৮ উইকেট, সেখান থেকে অজিদের জয় ছিল শুধুই সময়ের ব্যাপার। কিন্তু ফিনিক্স পাখির মতো ঘুরে দাঁড়ানোর দুর্দান্ত রূপকথার গল্প লিখলেন ক্রিকেটের বরপুত্র ব্রায়ান লারা,যা কেবল্মাত্র তার পক্ষেই সম্ভব।
প্রতিপক্ষের আক্রমনের জবাবে আগে ডিফেন্ড করে গেলেন, হয়তো ভেবেছিলেন, ‘আগে তুমি খেলো, তারপর খেলব আমি।’ সেটাই হলো, বোলাররা প্রথমে চেপে ধরলেও টলাতে পারলো না লারার মনোযোগ, ফলে এরপর বোলারদের নিয়ে করলেন রীতিমতো ছেলেখেলা। পেসারদের প্রতিটা বাউন্সারের জবাবে খেললেন সামনের পা উঠিয়ে সেই ট্রেডমার্ক পুল-হুক শট, স্পিনারদের বল ডাউন দ্য উইকেটে এসে করেলেন মাঠ ছাড়া। ম্যাচের আগে অজিরা প্রাকটিস করতে দেয়নি নেটে ভালোভাবে। প্রতিটা কাভার ড্রাইভ কিংবা স্ট্রেট ড্রাইভে সেই রাগেরই প্রতিফলন ঘটছিল যেন।
দলগত সব খেলায় একজন খেললেই তো আর হলো না, খেলতে তো হয় সবার। অন্তত সাহস যোগানো কিংবা সমর্থন দেয়ার জন্য হলেও একজনকে থাকতে হয়। লারা একা খেলে গেলে তো আর হচ্ছে না, ম্যাচ জিততে অপরপ্রান্তে কারও দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা সঙ্গ দিতে তো হবেই।আরে অজি গ্রেট গ্লেন ম্যাকগ্রা অপরপ্রান্তে একে একে তুলে নিলেন জিমি অ্যাডামস,রিডলি জ্যাকবস আর পেরিকে।
জয় পেতে উইন্ডিজের তখনও শোধ করতে হবে ৬১ রানের ঋন। হাতে আছে মাত্র দুই উইকেট। লারা নবম উইকেটে অ্যামব্রোসের সঙ্গে গড়লেন মহামূল্যবান ৫৪ রানের আরেক জুটি। সেখানে অ্যামব্রোসের অবদান শুধু ১২। কিন্ত এই ১২ রানের মহিমা ওই মুহূর্তে ১২০ রানের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। রোমাঞ্চের বাকি ছিল তবুও। জয় থেকে মাত্র ছয় রান দূরে থেকে আউট হয়ে গেলেন অ্যামব্রোস । ক্রিজে আসলেন ওয়ালশ।
বোলার ওয়ালশ আর ব্যাটসম্যান ওয়ালশের মধ্যে পার্থক্য আকাশ আর পাতালের দূরত্ব। বোলিংয়ে যতটা দুর্ধর্ষ, ব্যাটিংয়ে ঠিক ততটা সাদামাটা ওয়ালশ!টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ডাকের রেকর্ডও তার। সেই ওয়ালশ এর জন্য এক বল টিকে থাকাও অনেক বড় কিছু। ওয়ালশ টিকলেন পাঁচ পাঁচটি বল। তার দায়িত্ব ছিল আউট না হয়ে লারাকে কাজটা করতে দেওয়া। হলোও তাই। বাউন্ডারি মেরে দলকে জিতিয়ে লারা যখন দুহাত উঁচিয়ে উল্লাস করছেন, ততক্ষণে ব্রিজটাউনের সবুজ গালিচায় শুরু হয়ে গেছে আনন্দের বন্যা।
বিস্ময় আর অবিশ্বাসের চোখে ভিড় ঠেলে যখন মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন স্টিভ ওয়াহ, ভাবছিলেন হয়তো, ‘এও কি সম্ভব?’ । টেস্ট শেষেই আক্ষেপ করে বলেছিলেন, এটাই তার সেরা টেস্ট।টেস্ট ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ইনিংস হিসেবে ধরা হয় এটাকেই। এ যেন অবিশ্বাস্য, অবিস্মরণীয়!
২.
ছোটবেলায় মাত্র ছয় বছর বয়সেই বড় বোন আর বাবার হাত ধরে ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হন এগারো ভাইবোনের মাঝে দশম সবার আদরের ‘প্রিন্সি’। এরপর সেন্ট জোসেফ রোমান ক্যাথলিক স্কুলে ভর্তি হলেও পরবর্তীতে ভর্তি হন স্যান জুয়ান হাই স্কুলে। তবে ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর প্রতিভার বিকাশ পায় ১৪ বছর বয়সে যখন তিনি ফাতিমা কলেজে ভর্তি হন।
তরুণ কোচ হ্যারি রামদাশের অধীনে শুরু হয় তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের যাত্রা। ইন্টার স্কুল কম্পিটিশন টুর্নামেন্টে ১২৬.১৬ গড়ে ৭২৪ রান করে জায়গা পান ত্রিনিদাদের অনূর্ধ্ব-১৬ দলে। এক বছর পর লারার বয়স যখন পনের, তিনি ডাক পান ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। ১৯৮৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশিপে ৪৯৮ রানের ইনিংসের মাধ্যমে কার্ল হুপারের ৪৮০ রানের রেকর্ড ভাঙেন লারা।
পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৮৮ সালে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে লারার অভিষেক, প্রতিপক্ষ ছিল লিওয়ার্ড আইল্যান্ড। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচে বার্বাডোসের বিপক্ষে ৩০০ মিনিট ক্রিজে থেকে খেলেন ৯২ রানের এক ম্যারাথন ইনিংস। প্রতিপক্ষের বোলিং লাইনআপে ছিলেন নব্বই দশকের বিধ্বংসী বোলার, দুই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কিংবদন্তি ম্যালকম মার্শাল আর জোয়েল গার্নার। ওই বছরই ভারত অনূর্ধ্ব-২৩ দলের বিপক্ষে খেলেন ১৮২ রানের আরেকটি দুদান্ত ইনিংস। ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনূর্ধ্ব-২৩ দলের অধিনায়ক। পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতায় প্রথমবারের মতো ডাক পান ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দলে।
জাতীয় দলে অভিষেকের ঠিক আগে ঘটে তার জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। টেস্ট অভিষেকের আগের রাতে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান তার বাবা। বাবার মৃত্যুতে দল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন লারা। দুর্ঘটনাটি অনেকটাই ভেঙে দেয় তাঁকে।
শোক কাটিয়ে আবার ক্রিকেটে মনোযোগী হন লারা। ১৯৯০ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর সর্বকনিষ্ঠ অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন লারা। একই বছর প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের উপস্থিতি জানান দেন লারা। পাকিস্তানের বিপক্ষে ন্যাশনাল স্টেডিয়াম, করাচিতে ওয়ানডে অভিষেক হয় লারার।
ওয়াকার ইউনিসের বলে আউট হওয়ার আগে করেন পারেন মাত্র ১১ রান। এক মাস পর একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে গাদ্দাফি স্টেডিয়াম, লাহোরে পরম আকাঙ্ক্ষিত টেস্ট ক্রিকেটে পথচলা শুরু হয় ব্রায়ান লারার। কিন্তু হায়!৪৪ আর ৫ রান করে আউট হন নিজের প্রথম টেস্টে।
৩.
সকালের সূর্য সবসময় সঠিক দিনের পূর্বাভাস দেয় না।
জানুয়ারি ১৯৯৩। ব্রায়ান লারার পঞ্চম টেস্ট, প্রতিপক্ষ পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়া।প্রথম ইনিংসে ব্যাট করে ৫০৩ রানের বিশাল স্কোর অজিদের। ব্যাটিংয়ে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাত্র ৩১ রানেই ২ টি উইকেট পড়ে গেল। ফলো-অনের আশঙ্কা মাথায় নিয়ে মাঠে নামলো ৪ টেস্টের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একটা ব্যাটসম্যান যার কিনা সিরিজের আগের দুই টেস্টের গড় মাত্র ২৮.৫০।
কিন্তু নামার পরেই বিশ্ব যেন নতুন একজন ব্যাটসম্যানকে দেখতে পেল। সাবলীল ব্যাটিং করে তুলে নিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। কিন্তু যার জন্মই হয়েছে বড় ইনিংস খেলার জন্য তিনি করে মাত্র সেঞ্চুরি করে সন্তুষ্ট থাকেন!!তিনি ছিলেনও নাহ।।মার্ভ হিউজ, ক্রেইগ ম্যাকডারমট, শেন ওয়ার্নদের পাড়ার বোলারে নামিয়ে এনে খেলেন ২৭৭ রানের ইনিংস।
এতোটাই সাবলীল ছিলেন যে ম্যাচের ধারাভাষ্যকাররা বলছিলেন, ‘এই ব্যাটসম্যানকে আজ আউট করা সম্ভব না। একমাত্র রান আউটই পারে তাকে আউট করতে।’
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সেদিন তিনি রান আউটই হয়েছিলেন।
১৮ এপ্রিল, ১৯৯৪। অ্যান্টিগা টেস্টে মুখোমুখি ওয়েস্ট ইন্ডিজ-ইংল্যান্ড। ১১ রানে প্রথম উইকেট পড়ার পর ক্রিজে আসলেন লারা। ১২ ঘন্টা ক্রিজে থেকে ৫৩৮ বলে ৪৫ বাউন্ডারিতে করলেন ৩৭৫ রান! এই রান করার পথে অতিক্রম করলেন ১৯৫৮ সালে স্যার গারফিল্ড সোবার্সের করা ৩৬৫ রানের বিশ্বরেকর্ড। লারার রেকর্ড টিকে ছিল প্রায় ১০ বছর,২০০৩ সালে ম্যাথু হেইডেন ৩৮০ রান করেন ভাঙেন লারার রেকর্ড।
২ জুন, ১৯৯৪। বার্মিংহামের এজবাস্টনে ডারহাম বনাম ওয়ারউইকশায়ারের ম্যাচে ওয়ার্কউইকশায়ারের হয়ে খেলতে নামেন লারা। চার দিনের ম্যাচটিতে টসে জিতে ব্যাট করতে নামে ডারহাম। জন মরিসের ২০৪ রানের সুবাদে ৮ উইকেট হারিয়ে দ্বিতীয় দিনে ৫৫৬ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে ডারহাম। দ্বিতীয় দিনেই ব্যাট করতে নামে ওয়ারউইকশায়ার। দ্বিতীয় দিনেই ২ উইকেট হারিয়ে ২১০ রান সংগ্রহ করে ওয়ারউইকশায়ার। ১১১ রান করে অপরাজিত থাকেন লারা।
তৃতীয় দিনে খেলা হয়নি। তারপরের দিনও রেস্ট ডে হিসেবে খেলা হয়নি। তারপরের দিন আজকের দিনে তথা ৬ জুন মাঠে গড়ায় চতুর্থ ও শেষ দিনের খেলা। চতুর্থ দিনে প্রথম ইনিংসের খেলা গড়ানোয় ম্যাচে ফলাফল আসবে না তা নিশ্চিতই ছিল, আর তাই হয়তো নির্ভার হয়ে ব্যাট হাতে ঝড় তোলেছিলেন লারা। একে ট্রেভর পেন্নই, পল স্মিথ ও কিথ পিপারকে নিয়ে জুটি বেঁধে খেলেন ইতিহাস সৃষ্টিকারী ৫০১ রানের ইনিংস। মাত্র ৪২৭ বলে ১০টি ৬ ও ৬২ চারে ৫০১ রানে অপরাজিত থাকেন লারা। কিথ পিপার ১৫১ বলে ১১৬ রান করে অপরাজিত থাকেন। ৪ উইকেট হারিয়ে ৮১০ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে ওয়ারউইকশায়ার। ড্রয়ে পরিণত হয় ম্যাচটি।
লারা ৫০১ রানের ইনিংস খেলার পথে ভেঙেছেন পাকিস্তানি কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান হানিফ মোহাম্মদের ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানি ঘরোয়া লিগ কায়েদ–এ–আজম ট্রফিতে করাচির হয়ে খেলা ৪৯৯ রানের রেকর্ড ইনিংস।
ফার্স্ট ক্লাস আর টেস্টের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ভাঙার পর বাকি থাকে ওয়ানডের সর্বোচ্চ রান। সেই সময়ে খুব কম মানুষই ছিলেন যারা বিশ্বাস করতেন না যে, রেকর্ডটি লারাই ভাঙবেন। শারজায় শ্রীলংকার বিপক্ষে লারা সেটা প্রায় করেও ফেলেছিলেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৬৯ রানের সেই ইনিংস খেলতে বল খেলেছিলেন মাত্র ১২৯ টি।
২০১৭ সালের টি-টোয়েন্টি যুগে রান আর বলের পার্থক্যটা খুব সামান্য মনে হলেও ১৯৯৫ সালের প্রেক্ষাপটে সেটা অস্বাভাবিক ছিল। যদিও বর্তমান যুগেও ১২৯ বলে ১৬৯ রানের ইনিংস ক্লাসিক্যাল বলেই গণ্য হয়। ধর্মসেনার একটা নিরীহ দর্শন বলে যখন আউট হন তখন বল বাকি আছে ৩৩ টি। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারলে তৎকালীন ১৮৯ রানের রেকর্ডটা যে তিনি নিজের করে নিতেন সেটা নিয়ে কারো মনে এখন পর্যন্ত কোন দ্বিধা নেই।
৪.
ব্রায়ান লারার সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল পুরোপুরি তার উপর নির্ভর ছিল। একজন ব্যাটসম্যান একটা দলের কতটা সমার্থক হতে পারে?
ব্যাপারটা অনেক ভাবেই বুঝা যায়। এখানে একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যে, ব্রায়ান লারার সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজের মোট রানের ২০% তার করা। এই ক্ষেত্রে তার উপরে আছেন মাত্র দুজন। একজন ব্র্যাডম্যান (২৩%) এবং অন্যজন হলেন ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান খ্যাত জর্জ হেডলি (২১%)।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩ টেস্টের একটা সিরিজে দলের মোট রানের ৪২% ছিল তার করা, যা কিনা একটি রেকর্ড। ৩ টেস্টে রান করেছিলেন ৬৮৮ রান। সিরিজের প্রথম দুই টেস্টে মুরালিধরন আনপ্লেয়েবল হয়ে উঠেছিলেন। প্রথম টেস্টে নিলেন ১১ উইকেট, ২য় টেস্টে ১০ উইকেট। উইন্ডিজ ব্যাটসম্যানরা তার বল বুঝতেই পারছিলেন না। কিন্তু এর মাঝেও ব্যতিক্রম ছিলেন ব্রায়ান লারা।
সেই সিরিজের একটা ঘটনা। রামনরেশ সারওয়ান কিছুতেই মুরালির দুসরা বুঝতে পারছিলেন না। কিভাবে দুসরা পিক করতে হবে সেটা ব্রায়ান লারা বার বার বুঝিয়ে বলার পরেও কোন কাজ হচ্ছিল না। পরের ওভারে ছক্কা মারার পর সারওয়ানকে ঢেকে বললেন ‘ওটা ছিল দুসরা’। সিরিজের পর দুঃখ করে লয়েড বলেছিলেন, ‘উইন্ডিজ ক্রিকেটের ক্ষয়িঞ্চু সময়ে জন্মানটা লারার দুর্ভাগ্য। একজন খেলোয়াড় এর চেয়ে বেশি আর কী করতে পারেন?’
৫.
‘তুমি নিজেকে এতটা নিচে নামাতে পারো না’
এই ছিল ব্রায়ান লারাকে পাঠানো ভিভ রিচার্ডসের বার্তা। অ্যান্টিগা টেস্ট শুরুর ঠিক আগে আগে। সেটি ২০০৪ সাল। ইংল্যান্ড সিরিজের প্রথম তিন টেস্টের ছয় ইনিংসে লারার রান ছিল সাকল্যে ১০০। দল হেরেছিল তিন ম্যাচই। চারপাশ থেকে ধেয়ে আসছিল সমালোচনা।লারা নিজেই বলেছিলেন, আরেকটি টেস্ট হারলে হয়ত অধিনায়কত্বই কেড়ে নেওয়া হবে। ক্যারিয়ার জুড়ে এভাবেই অসংখ্যবার সমালোচনার তিরে রক্তক্ষরণ হয়েছে তাঁর।
তবে কোনোবারই রক্ষক্ষরণে কাহিল হননি, বরং বিন্দু বিন্দু জবাব দিয়েছেন। দু:সময়কে পাল্টা জবাব লারার মত করে দিতে পারেননি ক্রিকেটে আর কেউ। সেবারও দিয়েছিলেন। অনুপ্রেরণা ছিল ভিভের সেই বার্তা। ওই মাঠের কিউরেটর তখন অ্যান্টিগারই আরেক কিংবদন্তি অ্যান্ডি রবার্টস। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের স্বর্ণযুগের সারথি তিনি, দলের হোয়াইটওয়াশ হওয়ার শঙ্কায় এমন উইকেট বানালেন, যেটি পাকা সড়কের চেয়েও নিষ্প্রাণ। কাঙ্খিত টস জিতলেন লারা।
ড্যারেন গঙ্গা আউট হওয়ার পর যখন উইকেটে গেলেন তিনি, ম্যাচের বয়স ঘন্টাখানেক। চতুর্থ বলেই জোড়ালো এক কট বিহাইন্ডের আবেদন থেকে বেঁচে যান স্টিভ হার্মিসনের বলে। একটা শব্দ মতো শোনা গিয়েছিল, সাড়া দেননি ড্যারিল হেয়ার।
এরপর আর সমস্যা হয়নি। বৃষ্টিবিঘ্নিত প্রথম দিন শেষে অপরাজিত ৮৬। দ্বিতীয় দিনেই সেঞ্চুরি ছুঁয়ে, ডাবল সেঞ্চুরি হয়ে পেরিয়ে গেলেন ট্রিপল সেঞ্চুরি। দিন শেষে অপরাজিত ৩১৩। ইতিহাস হয়ে গেছে তখনই, ডন ব্র্যাডম্যানের পর প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে দুটি ট্রিবল সেঞ্চুরি। তবে হাতছানি তখন আরও বড় কীর্তির!
তৃতীয় দিনে লাঞ্চের আগে-পরে দুদফায় লিখলেন নতুন ইতিহাস। মাত্র ছয় মাস আগেই টেস্টের সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ডটি হারিয়েছিলেন ম্যাথু হেইডেনের কাছে। লারার ৩৭৫ ছাড়িয়ে হেইডেন করেছিলেন ৩৮০। এবার লাঞ্চের একটু আগে ৩৭৪ থেকে অফ স্পিনার গ্যারেথ ব্যাটির বলে ডাউন দ্য উইকেটে ছক্কায় লারা স্পর্শ করলেন ৩৮০।
পরের বলেই সুইপ করে বাউন্ডারিতে আবারও সবচেয়ে উঁচু চূড়ায়। মাত্র ১৮৫ দিনেই হেইডেনের কাছ থেকে কেড়ে নিলেন নিজের রেকর্ড। প্রথম রেকর্ড গড়ার ১০ বছর পর আবারও একই রেকর্ড গড়ে আরও একবার বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন নিজের বিস্ময়কর ব্যাটসম্যানশিপ!
থামেননি সেখানেই। ৩৯০ রান নিয়ে গিয়েছিলেন লাঞ্চে। লাঞ্চের খানিক পর সেই ব্যাটির বলেই সুইপ করে আরেকটি সিঙ্গেলে ৪০০। কমেন্ট্রি বক্সে বব উইলিস (সম্ভবত) বলেছিলেন, ‘পারহ্যাপস দা মোস্ট সিগনিফিকেন্ট সিঙ্গেল এভার ইন দা হিস্ট্রি অব টেস্ট ম্যাচ ক্রিকেট।’
টেস্ট ইতিহাসের প্রথম কোয়াড্রপল!
৬.
২০০৭ বিশ্বকাপের ২১ এপ্রিল। ইংল্যান্ড আর উইন্ডিজের বিপক্ষে গুরুত্বহীন একটা ম্যাচ। উইন্ডিজ আগেই বাদ পড়ে গিয়েছে। শেষ ম্যাচটা নিয়ম রক্ষার একটা ম্যাচ। কিন্তু সেই নিয়ম রক্ষার ম্যাচটাই হয়ে গেলো বিশ্বকাপের সবচেয়ে আকর্ষণীয়। কারণ এই ম্যাচটাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্রায়ান লারার শেষ ম্যাচ।
রাজার মতোই খেলা শুরু করলেন ব্রায়ান লারা। তিনটা চারের সাহায্যে ১৭ বলে করলেন ১৮ রান। কিন্তু সতীর্থ স্যামুয়েলসের ভুলে রান আউট হয়ে গেলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শেষ ইনিংসে উইকেটটা কোন বোলারকে দিবে না হয়তো, উপরওয়ালা লিখে রেখেছিলেন। মাঠ থেকে বের হয়ে যাবার সময় ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দর্শকদের দিকে একটা প্রশ্ন করেছিলেন ব্রায়ান লারা, ‘ডিড আই এন্টারটেইন’?
উত্তরটা সবার জানা!
৬.
লারার ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় তুলনা করা হতো আরেক শচীন টেন্ডুলকারের সাথে। পরিসংখ্যানে শচীন এগিয়ে থাকলেও সেসময়ের বেশিরভাগ বোলার কিংবা ধারাভাষ্যকাররা এগিয়ে রাখতেন লারাকে কারণ লারা ছিলেন ম্যাচ উইনার।একাই ধসিয়ে দিতেন প্রতিপক্ষকে।
এ প্রসঙ্গে অজি গ্রেট রিকি পন্টিং একবার বলেছিলেন, ‘পরদিন টেন্ডুলকার ব্যাটিং করবে জানলে আমার রাতের ঘুমে সমস্যা হতো। কিন্তু ব্যাটসম্যানের নাম লারা হলে রাতটা বিনিদ্রই কাটতো। চাইলে টেন্ডুলকারকে আটকে রাখার একটা পথ বের করা সম্ভব ছিল, কিন্তু লারা আধঘণ্টার মধ্যে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারতো। আমার কাছে সেঞ্চুরির চেয়ে ম্যাচ বা সিরিজ জেতানোটাই সব সময় বেশী মূল্য পেয়ে এসেছে।’