অন্য সব ছবি বড্ড কালারফুল। রঙ্গিবিরঙ্গী ছবির লাইন পড়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিশেষত, কোনও প্লেয়ার যদি হয় আউটস্ট্যান্ডিং, তবে তো কথাই নেই! তার চরণতলে নতজানু হয়ে দরাজ কণ্ঠ – ‘দিল মে হো তুম, আঁখো মে তুম’।
এ ছবির গল্প আলাদা। স্কুলের যে কোনও সেকশনে কোনও দিন ফার্স্ট বেঞ্চে জায়গা না পাওয়ার গল্প। ভীত, সন্ত্রস্ত, নখ খুঁটে খাওয়া, ইতিউতি চাহনির ছোটগল্প। রবীন্দ্রনাথ লিখলে ভাল করতেন। তার বদলে লিখতে হয় চকমকিদের! এ ছবিটা সাদা, আবার কালো। শান্তি অথবা অশান্তি। পাওয়া, অথবা না পাওয়া। আলো, অথবা আঁধার, পাহাড় কিম্বা সমুদ্র, সবুজ অথবা হলুদ।
এ ছবিটা সবার থেকে আলাদা। ঝাপসা, ভাল করে মুখ চেনা যায় না। টগবগে ঘোড়ায় চাপা রাজপুত্রের মত আগমন-টনের ঝলকানি নেই এখানে। এখানে বিদায় নেই, বিদায়গাথা নেই। বীরগাথা নেই। সেই লাস্ট বেঞ্চে বসা চুপচাপ ছেলেটার মত। কারোর সাথে কথা বলে না। নিজের মতই থাকে। যাপনের অভ্যাস স্বতন্ত্র। পর্বত আর মহম্মদের ঘনঘটা নেই। ভগবানও মুখ তুলে চায় না। পথের ধারে নিজের আঁকা ছবি নিয়ে বসে থাকে আধময়লা পাঞ্জাবি পরে। কেউ যদি কেনে, কেউ যদি চেনে। কেউ যদি একবার ফিরে তাকায় – আরে! তুমি সে-ই না? হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে-ই বটে।
বেয়ার লেভারকুসেনের জার্সি গায়ে পরপর তিনটে চ্যাম্পিয়নশিপে সেকেন্ড! বহু চেষ্টাচরিত্র করেও কিছুতেই প্রথম স্থান অধিকার করতে এ ছোকরা তো ভারি অক্ষম। এ এক অদ্ভুত সমাপতন। অবগুণ্ঠন সে কিছুতেই ভেদ করতে পারে না। ডিএফবি পোকাল, বুন্দেশলিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ হাতছাড়া! হঠাৎ কোথা থেকে উসাইন বোল্টের মতো জিদান বাঁ পায়ে ভলি মেরে বেরিয়ে গেল। আরে, বড় অদ্ভুত তো! একটুও মায়াদয়া নেই যে শরীরে – মাথা চাপড়ে আর ক’দিন, ক’মাস?
ভিয়ারিয়ালের জার্সি গায়ে পেনাল্টিটা নেবার পর-মুহূর্তেই বোধহয় এটা মনে হয়েছিল জুয়ান রোমান রিকেলমের। আর কদিন?
তবে রিকেলমে পেলেন কিছু জীবনে। অলিম্পিকে সোনার মেডেল ঝুলে পড়ল গলে। আর পথে পথে ফুটবল ফেরি ক’রে বেড়ালেন চিরঞ্জীবী। মাথার মণি কেউ ছেলেবেলায় তার কপালে ছুঁইয়েই লুকিয়ে ফেলেছিল। আর মিথ্যে ক’রে বলেছিল, ‘এই যে ছুঁয়ে দিলাম অরুণ আলোর সোনার কাঠি।’ বদলে হড়হড় করে শনি নেমে এল। ফুটবল আশীর্বাদ না অভিশাপ?
মত্ত অবস্থায় বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধের স্বীকারক্তি দিয়েছিলেন ফুকস্। আর তাঁর স্বীকারোক্তি! একের পর এক ব্যভিচারের প্রত্যাঘাত নেই কোনও?
ব্যভিচারই তো! দিনের পর দিন এক মায়াবী নারীকে মনের শেষ অন্তঃস্থল থেকে ভালবাসা উজাড় ক’রে দেওয়ার পর হঠাৎ কানে বেজে উঠল – ‘আমি বাগদত্তা।’ স্বপ্ন একটু একটু করে বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে দেখলেন আর এই তো কয়েকটা মিনিট। তারপরেই আমি ছুঁতে পারব ঐ রুপোর ট্রফিখানা। রাশিয়া দেখবে চেয়ে চেয়ে। ঠিক তার দু’মিনিট পর দলের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সৈনিক ভুল করে বসল। একেবারে ম্যানহাটন প্রজেক্টের সবচেয়ে গোপন ফর্মুলাটা রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়ার মত ভুল। ডুবিয়া গিয়াছে পঞ্চমীর চাঁদ, মরিবার হল তার সাধ।
পঞ্চাশ বছর কেটে গিয়েছে রাইন নদীর জলের স্রোতের মত। দস্তখত পাওয়া গিয়েছে ছেঁড়াফাটা। এমন দলিল হাতে না পড়লেই বরং নিশ্চিন্ত হওয়া যেত –
কাকভোর। হাতে কুকুরের চেন, মুখে পাইপ, গায়ে ওভারকোট। প্রাত:ভ্রমণে বার হয়েছেন এক বৃদ্ধ। সঙ্গে একটি ছোট ছেলে। তাঁরই কেউ হবে। চারদিকে ঘন কুয়াশা, তার মধ্যেই মুখনি:সৃত পাইপের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে আকাশের পানে। সেই সঙ্গে আরও একটা জিনিস, যা লোকটার কদমের সাথে তাল মেলাতে না পেরে আগে আগে ছুটছে। সেটা লোকটার চিন্তা। এই ভদ্রলোকও তো জার্মানিরই বাসিন্দা। শুধু ইনি কেন, কোয়ান্টামের জনক, গাটেনগান ইউনিভার্সিটি, রাইন নদী, বিশ্বকাপের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গোলের মালিক, নিকৃষ্টতম জীব – সবাই তো এই জার্মানিরই জল খেয়েছেন। তবে এই যে জীবন, তার জাবেদা খাতার প্রতিটা পাতা শনির সংকেতে ভরে উঠল কেন।
জুডাস! পৃথিবী আমার কাছে জুডাস। না না, অন্য কিছু নয়- জুডাসই! না হলে জন টেরি শেষ লগ্নে পেনাল্টি ফসকায়? জন টেরি! ক্লদিও ম্যাকলেলে ঐ পাসটা মিসজাজ করে? দেল পিয়েরো গোটা বিশ্বকাপে ঐ একটাই গোল করে – যা হৃদয়টাকে টুকরো টুকরো করে কেটে রেখে গিয়েছিল, জুডাস ছাড়া আর কী! প্রমিথিউসের ভাগ্য তো ছিল না। তার বদলে জুডাস? এ কী অমোঘ ছেলেখেলা হে জিসাস।
আরও বলব? ২০১০। এফ এ কাপ ফাইনালে ওর’ম বিচ্ছিরি ট্যাকলটা না হলে কোনও ঈশ্বরের সাধ্য ছিল বিশ্বকাপ খেলা আটকানোর? না, ছিল না। ফিলিপ লাম আর্মব্যান্ড পায় না। ভাগ্যবিধাতা সুপ্রসন্ন ছিলেন না কোনওদিন, ইয়েস ইয়েস!
কোনওদিনও না। লাগামছাড়া দুর্নীতিবাজ ভগবান! আই কান্ট বিলিভ ইট!
ঐ হতচ্ছাড়ার জন্য সেমিফাইনালে হলুদ কার্ড দেখতে হয়েছিল। নইলে কোরিয়ায় ফাইনাল খেলা আটকায় না। অত সহজে ২-০ হয়? আসলে, জার্সি নম্বরটাই যে ১৩!
বজ্রআঁটুনি রুখতে পারেনি ফস্কা গেরোকে। তাকে লুকিয়ে বুন্দেশলিগা, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ আর তিন-তিনটে এফ এ কাপ চালান হয়ে গেছে ট্রফিরুমে। তবুও কি দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে? যে ট্রফি দু’খানির পাশ দিয়ে শুধু হাঁটাই হল সার। চোটেই গেল তার কিছুটা। চোট— চোট বলতে কী বুঝলেন? মানসিকটাও অ্যাড করুন। তোরেসকে লাম আটকাতে পারল না। দেল পিয়েরোকেও না। রোনাল্ডোকে আটকানোর সাধ্যি যার ছিল, সেই কান ধুলুণ্ঠিত হল। এমন এ কুদরতের খেল, ‘কিছুদিন আগে আমার ছেলেটাকেও আমার আগে ডেকে নিল!’
এটুকুই অবশিষ্ট ছিল। বালাক যে পাগল হয়ে যাননি, তার জন্য তিনি পূর্বে সঞ্চিত হিমালয়ান্তিক অভিযোগগুলি নস্যাৎ করে দিতে পারেন।
হারানো। আমরা হারানোর ভয় পাই। বাবা-মাকে হারানোর, প্রেমিক-প্রেমিকাকে হারানোর, নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসকে হারানোর। এই হারানোর বড় প্যারাডাইমকে হেলায় নাকচ করে দিয়ে বালাক যেটা আদতে করেছিলেন, তার জন্য তাকে হৃদয় খুলে দেওয়া যায় নিশ্চিতভাবে। তিন-তিনবার জার্মানির সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলাররের শিরোপা। আজও জার্মানিতে ক্যাপ্টেন বললে কাইজার বেকেনবাওয়ারের পরেই উজ্জ্বল রেখায় নামাঙ্কিত তাঁর নাম – মাইকেল বালাক।
ভিন্সেন্ট বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর একশো বছর পর ছবিগুলি শোভা পাবে পৃথিবীর প্রতিটি বিখ্যাত মিউজিয়ামে। বালাক ভিন্সেন্টের মতো শিল্পী ছিলেন না, অথচ জীবনধারার প্রতিটা ভাঁজ অব্যর্থ ভাবে মিলে যাচ্ছে তার সাথে। ট্রফি কি আর সব গল্প বলে? বলতে পারে? জীবনের প্রতিটা টাচলাইনে, মিডফিল্ডে যে স্বরলিপিগুলো বালাক সাজিয়ে এসেছিলেন জার্মানিতে, সেই স্বরলিপি ধরেই গান গেয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে তার রেখে যাওয়া জার্মান টিম।
ঐ বাস্তি, ঐ লাম, ঐ ক্লোসে, ঐ পোডলস্কি, ঐ শার্লে, ঐ নয়্যার – বালাক শেষ বিকেলের ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিত হাত নাড়েন। কার উদ্দেশ্যে জানা নেই, তবে এই হাতের রেখায় সাফল্য কোথাও না কোথাও ঘাপটি মেরে ছিল। আমরাই তাকে ঠিক চিনতে পারিনি। যেমন পৃথিবীতে আসা প্রতিটা ট্যালেন্টেড লোককেই চিনতে একটু দেরি হয় আমাদের।
জানিনা লোকে যা বলে সত্যি কি না, কপালে সবার নাকি সুখ সয় না। আসলে, সবাই তো সুখী হতেই চায়। তবু কেউ সুখী হয়, কেউ হয় না।